আমাদের চারপাশে এমন অনেক কিছুই আছে যা আদতে বিদেশি, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে আমাদের সাথে থাকতে থাকতে তা যেন ‘দেশি’ হয়ে উঠেছে। গাছপালার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া, সেগুন থেকে শুরু করে এমন বহু গাছ আছে যাদের আদি নিবাস বাংলাদেশ নয়। এই তালিকায় থাকা দুটি নাম নিয়ে বিতর্কটা বেশ পুরনো এবং জোরালো: ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি।
সম্প্রতি সরকার এই দুটি গাছের চারা তৈরি, রোপণ এবং কেনাবেচা নিষিদ্ধ করেছে। এই সিদ্ধান্তের পরেই পুরনো বিতর্কটি নতুন করে সামনে এসেছে। একদিকে যেমন এই গাছগুলোর বিরুদ্ধে পরিবেশ ধ্বংসের মতো গুরুতর সব অভিযোগ, তেমনই অন্যদিকে দেশের কাঠের বিশাল চাহিদা মেটাতে এদের ভূমিকার কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
তাহলে সত্যিটা কী? এই গাছগুলো কি আসলেই আমাদের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি? নাকি অর্থনৈতিক প্রয়োজনে এগুলো অপরিহার্য? চলুন, কোনো ব্যক্তিবিশেষের মতামত নয়, বরং গবেষণা ও বাস্তবতার নিরিখে এই জটিল বিতর্কের গভীরে প্রবেশ করা যাক।
পরিবেশের ‘খলনায়ক’? কেন এই গাছের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকাটা বেশ লম্বা। পরিবেশবিদ ও গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরেই কিছু গুরুতর উদ্বেগের কথা বলে আসছেন।
- অতিরিক্ত পানি শোষণ: সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, এই গাছগুলো মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এক ঘন সেন্টিমিটার কাঠ তৈরি করতে যেখানে মেহগনি গাছের প্রায় ১,৬১৫ মিলিলিটার পানি লাগে, সেখানে আকাশমণি শোষণ করে প্রায় ২,২২৩ মিলিলিটার এবং ইউক্যালিপটাস শোষণ করে প্রায় ৩,১৪৫ মিলিলিটার পানি। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায় এবং আশপাশের এলাকা ধীরে ধীরে শুষ্ক হয়ে ওঠে।
- মাটিকে অনুর্বর করা: এই গাছগুলোর পাতা ও বাকল থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ (ফেনলিক কম্পাউন্ড) নিঃসৃত হয়। বৃষ্টির পানির সাথে মিশে এই রাসায়নিক মাটিতে পড়ে এবং মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে। এটি মাটির আর্দ্রতা কমিয়ে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে মাটিকে রুক্ষ ও অনুর্বর করে তোলে।
- জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি: এই গাছগুলোতে দেশীয় পাখিরা সাধারণত বাসা বাঁধে না। এদের পাতা গরু-ছাগল বা অন্য কোনো গবাদিপশু খায় না। ফলে যে এলাকায় কেবল এই গাছগুলোর বাগান (মনোকালচার) করা হয়, সেখানে স্বাভাবিক খাদ্য শৃঙ্খল ব্যাহত হয়। এছাড়া, গাছের রাসায়নিক নিঃসরণের কারণে এর নিচে অন্য কোনো ছোট উদ্ভিদ বা ঘাস জন্মাতে পারে না, যা মাটির উপরের স্তর বা ‘আন্ডারগ্রোথ ভেজিটেশন’ নষ্ট করে দেয়।
- ফসলের জন্য ক্ষতিকর: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ইউক্যালিপটাস গাছের পাতার নির্যাস আশেপাশের ফসলের বীজের অঙ্কুরোদগমে বাধা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে মুলা, ছোলা, সর্ষে এবং বরবটির মতো ফসলের ক্ষেত্রে এই নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে।
এই সমস্ত অভিযোগের ভিত্তিতেই পরিবেশবাদীরা ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণিকে ‘আগ্রাসী প্রজাতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিস্তার রোধের দাবি জানিয়ে আসছেন।
অর্থনীতির ‘নায়ক’? কাঠের চাহিদা মেটাতে এদের ভূমিকা
বিতর্কের মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। পরিবেশগত অভিযোগের বিপরীতে এই গাছগুলোর শক্তিশালী অর্থনৈতিক যুক্তিও বিদ্যমান।
- কাঠের বিশাল চাহিদা পূরণ: বন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর কাঠের চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ ঘনফুট। এর বড় একটি অংশ আমদানি করতে হয়। এই বিশাল চাহিদা মেটাতে দ্রুত বর্ধনশীল ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির কোনো বিকল্প নেই বললেই চলে। মাত্র ৮ থেকে ১০ বছরেই এই গাছগুলো কাটার উপযোগী হয়ে যায়, যা দেশের আসবাবপত্র শিল্প এবং অন্যান্য কাঠের কাজে বড় জোগান দেয়।
- প্রাকৃতিক বনের ওপর চাপ হ্রাস: যদি এই গাছগুলো না থাকতো, তাহলে কাঠের এই বিশাল চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের প্রাকৃতিক বনভূমির ওপর চাপ বাড়ত। এর ফলে সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল আরও বেশি হুমকির মুখে পড়ত। এক অর্থে, এই ‘বিদেশি’ গাছগুলো আমাদের ‘দেশি’ বনকে রক্ষা করতে সাহায্য করছে।
- পতিত জমিতে বনায়ন: এই গাছগুলোর একটি বড় সুবিধা হলো, এরা খুব প্রতিকূল পরিবেশে জন্মাতে পারে। যেখানে লবণাক্ততা বা শুষ্কতার কারণে অন্য কোনো গাছ সহজে হয় না, সেই সব পতিত বা অবক্ষয়িত জমিতেও ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে। এর ফলে দেশের বনভূমির পরিমাণ বাড়াতেও এটি ভূমিকা রাখে।
- টিকে থাকার ক্ষমতা: অন্যান্য অনেক প্রজাতির তুলনায় এই গাছগুলোর টিকে থাকার হার অনেক বেশি। আশির দশকে যখন পরীক্ষামূলকভাবে এগুলো লাগানো হয়, তখন দেখা গেছে কিছু কিছু এলাকায় এদের টিকে থাকার হার ছিল প্রায় ৮৯ শতাংশ।
এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও উপযোগিতার কারণেই সরকারি উদ্যোগে আশির দশকে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় এই গাছগুলো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বিদেশি যখন দেশি: যেভাবে বাংলাদেশে এলো এই গাছগুলো
বাংলাদেশে বিদেশি গাছের আগমন কোনো নতুন ঘটনা নয়। উপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে বণিকদের হাত ধরে প্রায় ৩০০-এর বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ বাংলাদেশে এসেছে, যার মধ্যে গাছের প্রজাতিই প্রায় ৯৪টি। আমাদের অতি পরিচিত সেগুন, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, নারকেল, রাবার – এরা সবাই আদতে বিদেশি।
ইউক্যালিপটাসের ইতিহাসও বেশ পুরনো। জানা যায়, ১৯৩০ সালে সিলেটের চা বাগানে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য প্রথম এই গাছ আনা হয়। তবে এর ব্যাপক বিস্তার ঘটে আশির দশকে, যখন বন গবেষণা ইনস্টিটিউট কাঠের চাহিদা মেটাতে পরীক্ষামূলকভাবে ৩৪ প্রজাতির ইউক্যালিপটাস ও ১০ প্রজাতির আকাশমণি নিয়ে আসে। দীর্ঘ গবেষণার পর ৩টি করে প্রজাতি আমাদের দেশের আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত হিসেবে নির্বাচন করা হয় এবং বনায়নের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
নিষিদ্ধকরণই কি সমাধান? বিতর্কের ঊর্ধ্বে করণীয় কী?
সরকারের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা নিঃসন্দেহে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেবল নিষিদ্ধ করাই কি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমস্যাটা গাছের প্রজাতির চেয়েও বেশি ব্যবস্থাপনার। যেকোনো গাছের ‘মনোকালচার’ বা একক চাষাবাদ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। একটি বিশাল এলাকাজুড়ে শুধু একটি গাছের বাগান তৈরি করলে তা জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট করে। এর বদলে যদি মিশ্র বনায়ন করা হয়, অর্থাৎ দেশীয় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের সাথে মিশিয়ে ইউক্যালিপটাস বা আকাশমণি লাগানো হয়, তাহলে এর অনেক নেতিবাচক প্রভাব প্রশমিত করা সম্ভব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মিশ্র বাগানে ইউক্যালিপটাস থাকা সত্ত্বেও সেখানকার মাটির গুণাগুণ আদর্শ মান বজায় রেখেছে।
সুতরাং, সমাধান হতে পারে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি। যেমন:
- প্রাকৃতিক বন, জলাভূমি বা উর্বর কৃষি জমির আশেপাশে এই গাছ লাগানো সম্পূর্ণ বন্ধ করা।
- অবক্ষয়িত, পতিত বা লবণাক্ত জমিতে দেশীয় গাছের সাথে মিশ্রভাবে এগুলো লাগানোর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
- ইউক্যালিপটাসের বিকল্প হিসেবে কম পানি শোষণকারী দ্রুত বর্ধনশীল গাছ, যেমন মেহগনি, এর চাষাবাদে উৎসাহ প্রদান করা।
শেষ কথা
ইউক্যালিপটাস-আকাশমণি বিতর্কটি আসলে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার এক চিরায়ত বিতর্কের প্রতিচ্ছবি। এই গাছগুলোকে এক কথায় ‘শত্রু’ বা ‘মিত্র’ বলে চিহ্নিত করা কঠিন। কোথায়, কীভাবে এবং কী পরিমাণ লাগানো হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করে এর ফলাফল।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই কঠিন সময়ে আমাদের বনভূমি রক্ষা করা এবং একই সাথে মানুষের চাহিদা মেটানো – দুটোই জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত, দূরদর্শী ও টেকসই বন ব্যবস্থাপনা।
এই বিতর্ক নিয়ে আপনার মতামত কী? আপনি কি মনে করেন এই গাছগুলো পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা উচিত, নাকি নিয়ন্ত্রিত চাষাবাদের সুযোগ থাকা প্রয়োজন? কমেন্টে আপনার ভাবনা জানান এবং আসুন, আমাদের পরিবেশ রক্ষার এই সংলাপে অংশ নিই।