মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ফেরিঘাট এলাকায় সরকার একটি আন্তর্জাতিক মানের ইকো কনটেইনার পোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ–পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) মালিকানাধীন ২৯ দশমিক ৩১ একর জায়গায় এই বন্দর নির্মাণে আনুমানিক ৭৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এই উদ্যোগ একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইঙ্গিত দেয়, তেমনি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উদ্বেগও তৈরি করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বৃহৎ প্রকল্পে কিভাবে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা হবে? ৭৫৬ কোটি টাকার ইকো পোর্ট
সম্প্রতি শিমুলিয়া ফেরিঘাটে বিআইডব্লিউটিএর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের সভায় এই পরিকল্পনা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা এই সভায় অংশ নেন, যা প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে।
একটি সমন্বিত আলোচনার চিত্র
সভায় স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শিল্প ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এবং নৌপরিবহন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এই বহুমাত্রিক উপস্থিতিই বলে দেয়, প্রকল্পটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, এর সঙ্গে পরিবেশগত, সামাজিক এবং অবকাঠামোগত বিভিন্ন দিকও জড়িত। ৭৫৬ কোটি টাকার ইকো পোর্ট
সভা শেষে নৌপরিবহন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, “আমাদের বিআইডব্লিউটিএর যতটুকু জায়গা আছে, সেখানে আন্তর্জাতিক মানের ইকো কনটেইনার পোর্ট হবে। আমরা এখন পরিকল্পনা করছি। তবে কবে হবে, সেটি বলা মুশকিল। তবে পোর্টের জায়গায় শুধু পোর্টই হবে।” তার এই বক্তব্যে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কিছুটা স্পষ্ট হলেও, পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি।
শিমুলিয়ার ভবিষ্যৎ: শুধু বন্দর নয়, পর্যটন সম্ভাবনাও
শুধু বন্দরের বিষয়ই নয়, সভায় শিমুলিয়া এলাকায় রিভার মিউজিয়াম, ইকো রিসোর্ট, সুইমিংপুল, কিডস জোন এবং পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে একটি ফেরিঘাট পুনঃস্থাপন নিয়েও আলোচনা হয়। এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “বিষয়টি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা ও জেলা প্রশাসক বসবেন। আর কিছু জায়গার ব্যবস্থা করা যায় কি না, তাঁরা দেখবেন। যা করা দরকার, পূর্ণ সহযোগিতা করা হবে। এ জন্য আজ আমাদের এখানে আসা।”
এই আলোচনাগুলো শিমুলিয়াকে কেবল একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। তবে একটি ইকো কনটেইনার পোর্ট এবং ইকো-পর্যটন প্রকল্প কীভাবে সহাবস্থান করবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত না করে কোনো ধরনের ইকো-পর্যটন সফল হতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ বিবেচনায় এটি একটি সংবেদনশীল বিষয়।
শিমুলিয়া ঘাটের অতীত ও বর্তমান
একসময় দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের পদ্মা পাড়ি দেওয়ার অন্যতম প্রধান ভরসা ছিল মাওয়া–শিমুলিয়া ফেরিঘাট। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে ঘাটটি কার্যত অচল অবস্থায় রয়েছে এবং বর্তমানে এটি কেবল পার্কিং জোন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরিকল্পিত দোকানপাট, নাজুক অবকাঠামো ও পরিবেশ দূষণের কারণে দর্শনার্থীরা এই এলাকাবিমুখ হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, যা এই অঞ্চলের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে নতুন রূপ দিতে পারে। তবে অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে নতুন করে পরিবেশ দূষণ বা অবকাঠামোগত দুর্বলতা তৈরি না হয়।
বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান, ১৯ জুন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন শিমুলিয়া ফেরিঘাট এলাকা পরিদর্শনে আসেন এবং ঘাটকেন্দ্রিক একটি আইসিটি কনটেইনার ডিপো ও ইকোপার্ক করার বিষয়ে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে একাধিক খাতের সমন্বয় জরুরি। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের নিয়ে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য শিমুলিয়া ফেরিঘাটের একটি অংশ সচল রাখার বিষয়েও আলোচনা হয়। উন্নত দেশগুলোয় প্রধান যোগাযোগব্যবস্থা ছাড়া সব সময় বিকল্প ব্যবস্থাও সচল থাকে, এবং শিমুলিয়া ঘাটকেও সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত, পুলিশ সুপার মুহম্মদ শামসুল আলম সরকারসহ পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা।
পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা
শিমুলিয়া ঘাটে ইকো কনটেইনার পোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনা একদিকে যেমন বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চাহিদা পূরণে সহায়ক হতে পারে, তেমনি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গুরুতর চ্যালেঞ্জও সামনে নিয়ে আসে। “ইকো” শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ-বান্ধব হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হলেও, বাস্তবে এর বাস্তবায়ন কেমন হবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একটি বড় আকারের বন্দর নির্মাণ, কার্গো হ্যান্ডলিং এবং সংশ্লিষ্ট পরিবহন ব্যবস্থার কারণে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ এবং জলদূষণ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
পদ্মা নদীর পরিবেশগত সংবেদনশীলতা বিবেচনায়, এই প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে কঠোর পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) এবং কার্যকর পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (EMP) অনুসরণ করা অপরিহার্য। পাশাপাশি, স্থানীয় জীববৈচিত্র্য এবং নদীতীরের ইকোসিস্টেমের উপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলো কমিয়ে আনতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো নির্মাণও গুরুত্বপূর্ণ, যা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব থেকে বন্দরকে রক্ষা করবে।
শেষ কথা
শিমুলিয়া ঘাটে আন্তর্জাতিক মানের ইকো কনটেইনার পোর্ট নির্মাণের এই পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করবে না, বরং পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতারও একটি পরীক্ষা হবে। প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শক্তিশালী সমন্বয়, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, পরিবেশগত সুরক্ষার প্রতি অবিচল অঙ্গীকার।