29.7 C
Bangladesh
শুক্রবার, জুলাই ৪, ২০২৫
spot_img

হাওরের পানিতে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা র আসল উদ্দেশ্য কী?

প্রথমবারের মতো নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে মাছের প্রজনন মৌসুমে এক মাসের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার একটি খসড়া তৈরি করেছে সরকার। খবরটা শুনে হাওরপাড়ের জেলে থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবার মধ্যেই এক ধরনের আশার সঞ্চার হয়েছে। সরকারের এমন উদ্যোগকে সবাই একবাক্যে সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু ঠিক তার পরেই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে যে প্রশ্নটি উঁকি দিচ্ছে, তা হলো—এই মহৎ উদ্যোগ কি আদৌ আলোর মুখ দেখবে? কাগজে-কলমে থাকা একটি সুন্দর পরিকল্পনা কি হাওরের কর্দমাক্ত বাস্তবতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে? হাওরের পানিতে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা

মৎস্য অধিদপ্তর অবশ্য বেশ আশাবাদী। তাদের মতে, এই এক মাসের নিষেধাজ্ঞা সফলভাবে কার্যকর করা গেলে হাওরে কমে যাওয়া দেশীয় মাছের উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়বে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ ফেরাবে। জেলেরাও বলছেন, তারা সরকারের পাশে আছেন। পেটের ভাতের নিশ্চয়তা বা প্রণোদনা পেলে তারা এক মাস কেন, দুই-তিন মাসও জাল ফেলা থেকে বিরত থাকতে রাজি। হাওরের পানিতে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা

কিন্তু ঘোষণার মাইকিং হাওরের বাতাসে ভাসলেও, জেলেদের নৌকা কিন্তু এখনও পানিতেই ভাসছে। এই আপাত विरोधाभाসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি গভীর সংকট, যা শুধু মাছ বা জেলের জীবনযাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের পরিবেশ, দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তন এবং একটি অঞ্চলের টিকে থাকার লড়াই। হাওরের পানিতে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা

কেন এই উদ্যোগ? হাওরের বুকে হাহাকার

নেত্রকোনার মতো হাওরবেষ্টিত জেলার অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো দুটি—বোরো ধান আর মিঠা পানির মাছ। এই দুটিই প্রকৃতির দান। কিন্তু প্রকৃতির এই অফুরন্ত ভান্ডারে এখন টান পড়েছে। কলকারখানার ধোঁয়া বা দূষণ ছাড়াই এই অঞ্চলের মৎস্য সম্পদ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। পুঁটি, ট্যাংরা, মলা, ঢেলা—যে মাছগুলো একসময় হাওরের প্রতিটা ডোবায় ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত, সেগুলো এখন প্রায় দুর্লভ হয়ে উঠেছে।

এর কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণের এক জটিল জাল। অপরিকল্পিত মাছ শিকার, প্রজনন মৌসুমে মা-মাছ ও পোনা মাছ নিধন, কীটনাশকের ব্যবহার এবং সবচেয়ে বড় প্রভাবক—জলবায়ু পরিবর্তন। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অসময়ে বন্যা বা খরা হাওরের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রকে (ecosystem) ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হচ্ছে, যা সরাসরি এই অঞ্চলের মৎস্য সম্পদের উপর আঘাত হানছে।

এই ধ্বংসের মুখেই সরকার নতুন আশার আলো নিয়ে এসেছে। মৎস্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নেত্রকোনায় ছোট-বড় প্রায় ৯৪টি হাওর রয়েছে। বর্ষার শুরুতে, বিশেষ করে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি (২৯ মে) থেকে আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি (৩০ জুন) পর্যন্ত সময়টা হলো মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এই এক মাস যদি মা-মাছগুলোকে নিশ্চিন্তে ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া যায়, তবে মাছের উৎপাদন লাফিয়ে বাড়বে।

সরকারি পরিকল্পনা বনাম মাঠের বাস্তবতা

নেত্রকোনা সদরের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেবাশীষ সরকারের কথায় স্বপ্নের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তিনি জানান, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা গেলে বর্তমানের চেয়ে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার মেট্রিকটন মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। হাওরের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং চলছে, জনসচেতনতা তৈরির চেষ্টা চলছে, এমনকি মোবাইল কোর্ট চালানোরও পরিকল্পনা রয়েছে।

কিন্তু এখানেই গল্পের আসল মোড়। পরিকল্পনা যত সুন্দরই হোক, তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে দুটি জিনিসের উপর—সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা এবং কার্যকর প্রণোদনা। হাওরের একজন সাধারণ জেলের কাছে পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন-এর মতো ভারী শব্দগুলোর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তার পরিবারের রাতের খাবার। যে মানুষটির জীবন চলে প্রতিদিনের মাছ বিক্রির টাকার উপর, তাকে যদি বলা হয় এক মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখতে, তাহলে তার সংসার চলবে কীভাবে?

জেলেরাই এর সমাধান বাতলে দিয়েছেন। তাদের দাবি খুব সাধারণ—এই একটা মাস আমাদের খাদ্যের নিশ্চয়তা দিন, আমরা হাসিমুখে অপেক্ষা করব। সরকার বলছে, জেলায় প্রায় ৫৪,৬৯৫ জন মৎস্যজীবী রয়েছেন, যার মধ্যে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৭,১৩৫ জন। এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে প্রণোদনার আওতায় আনা নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জেলে কার্ড বিতরণ করা হলেও, সেই কার্ড দিয়ে সময়মতো প্রণোদনা পৌঁছানো যাবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। প্রচারণার পরেও যে জেলেরা এখনও মাছ ধরছেন, তা আসলে তাদের আইন অমান্য করার प्रवृत्ति নয়, বরং পেটের দায়ে নিরুপায় হওয়ার প্রতিচ্ছবি।

মাছের চেয়েও বড় স্বপ্ন: একটি সবুজ অর্থনীতির সম্ভাবনা

এই উদ্যোগকে যদি আমরা শুধু মাছ উৎপাদনের একটি প্রকল্প হিসেবে দেখি, তবে এর গুরুত্বকে খাটো করা হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. রাফিকুজ্জামানের কথায় এই দূরদৃষ্টির ছাপ পাওয়া যায়। তিনি বলছেন, এই উদ্যোগ সফল হলে জেলায় মাছের পর্যাপ্ততা বাড়বে, যা এই অঞ্চলের শিল্পায়নের একটি নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে।

ভাবুন তো একবার! নেত্রকোনার মতো একটি জেলায় তেমন কোনো বড় শিল্প-কলকারখানা নেই। এখানকার অর্থনীতি মূলত কৃষি ও মৎস্যনির্ভর। যদি দেশীয় মাছের উৎপাদনকে একটি টেকসই শিল্পে রূপান্তরিত করা যায়—যেমন মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং, এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ করার একটি সুসংগঠিত চেইন তৈরি করা—তাহলে হাওরের মানুষের জন্য বছরব্যাপী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। তাদের আর শুধু ধান বা মাছের মৌসুমের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না।

এটিই হলো একটি সবুজ অর্থনীতির মডেল। যেখানে পরিবেশ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পরের শত্রু নয়, বরং পরিপূরক। হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে, মৎস্য সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহার করে একটি অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চিত্র বদলে দেওয়া সম্ভব। এই নিষেধাজ্ঞা তাই শুধু মাছ বাঁচানোর চেষ্টা নয়, এটি একটি অঞ্চলের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে জলবায়ু পরিবর্তন-এর ঝুঁকির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

শেষ কথা

নেত্রকোনার হাওরে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার এই উদ্যোগ একটি ‘লিটমাস টেস্ট’-এর মতো। এর সাফল্য বা ব্যর্থতার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এটি প্রমাণ করবে, আমরা কি একটি পরিবেশবান্ধব নীতিকে প্রান্তিক মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম, নাকি আমাদের ভালো উদ্যোগগুলো কেবল কাগজের ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ, জেলেদের জন্য ন্যায্য প্রণোদনা এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতা—এই তিনের সম্মিলন ঘটলে হাওরের বুকে হয়তো আবার রুপালি মাছের ঝিলিক দেখা যাবে। কান্নার আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যাবে সমৃদ্ধির হাসি। এই উদ্যোগ সফল হলে এটি কেবল নেত্রকোনার জন্য নয়, সারা বাংলাদেশের অন্যান্য হাওর ও প্লাবনভূমির জন্যও একটি অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠবে।

আপনার মতামত কী?

আপনি কি মনে করেন, এমন উদ্যোগ হাওরের ভাগ্য সত্যিই পরিবর্তন করতে পারবে? জেলেদের জন্য প্রণোদনা নিশ্চিত করা কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে? পরিবেশজলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এমন স্থানীয় উদ্যোগের ভূমিকা নিয়ে আপনার ভাবনা আমাদের জানান কমেন্ট বক্সে। এই ধরনের বিশ্লেষণধর্মী পোস্ট পড়তে আমাদের পেজটি ফলো করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ