26.5 C
Bangladesh
শুক্রবার, জুলাই ৪, ২০২৫
spot_img

বৃক্ষমেলায় একদিন কাটালে মন কেন ভালো হয়ে যায়?

আপনি কি কখনও বেগুনি রঙের আম দেখেছেন? কিংবা ধবধবে সাদা জাম? অথবা এমন কাঁঠাল, যার কোষগুলো টকটকে লাল? যদি উত্তর ‘না’ হয়, তবে আপনার জন্য একটি দারুণ গন্তব্য অপেক্ষা করছে—জাতীয় বৃক্ষমেলা। তবে এই মেলা কেবল অদ্ভুত আর সুন্দর ফলের সমাহার নয়; এটি আমাদের পরিবেশ এবং আসন্ন জলবায়ু পরিবর্তন সংকটের প্রেক্ষাপটে এক বিশাল তাৎপর্য বহন করে। বৃক্ষমেলায় একদিন

ঢাকার শেরেবাংলা নগরে প্রতি বছরের মতো এবারও বসেছে সবুজের এই বিশাল আসর। এটি এমন এক জায়গা, যেখানে প্রবেশ করলে যান্ত্রিক শহরের ক্লান্তি আর কোলাহল নিমিষেই মিলিয়ে যায়। চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ—যেন এক精心ভাবে সাজানো বাগান। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর বার্তা, যা আমাদের সবার বোঝা প্রয়োজন। বৃক্ষমেলায় একদিন

বৃক্ষমেলা: একটি সবুজ বিপ্লবের চালচিত্র

১৯৯৪ সাল থেকে সাধারণ মানুষকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করতে এই মেলার যাত্রা শুরু। এর মূল লক্ষ্য ছিল দুটি: প্রথমত, বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব সম্পর্কে দেশব্যাপী প্রচার চালানো, এবং দ্বিতীয়ত, মানুষের দোরগোড়ায় ফলদ, বনজ, ঔষধি থেকে শুরু করে শোভাবর্ধনকারী সব ধরনের চারা পৌঁছে দেওয়া।

এবারের মেলার স্লোগান— ‘পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি’। এই একটি বাক্যই যেন বর্তমান সময়ের দাবিকে তুলে ধরে। ‘পরিকল্পিত বনায়ন’ এখন আর কেবল শৌখিনতা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার অন্যতম প্রধান উপায়। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সাধারণত এই মেলা শুরু হলেও, এবার কিছুটা দেরিতে শুরু হয়ে এটি চলবে আগামী ২৪ জুলাই পর্যন্ত। ১৩৩টি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে এই মেলা প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত। বৃক্ষমেলায় একদিন

মেলার তথ্যকেন্দ্রের সূত্রমতে, মানুষের আগ্রহ যে বাড়ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিক্রির পরিসংখ্যানে। ২০১৫ সালে যেখানে প্রায় ৩ কোটি টাকার চারা বিক্রি হয়েছিল, সেখানে গত বছর সেই বিক্রির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১৬ কোটি টাকা! এটি প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষ এখন পরিবেশ নিয়ে অনেক বেশি সচেতন।

কেন এই মেলা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি হাতিয়ার?

ভাবছেন, কয়েকটি গাছ কিনে ছাদে বা বারান্দায় লাগালেই কি জলবায়ু পরিবর্তন থেমে যাবে? উত্তরটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে, তার চেয়েও গভীর।

১. শহুরে উষ্ণতা হ্রাস: ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরগুলো কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হওয়ায় ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ (Urban Heat Island) ইফেক্টের শিকার। অর্থাৎ, এসব জায়গায় তাপমাত্রা আশপাশের গ্রামীণ এলাকার চেয়ে কয়েক ডিগ্রি বেশি থাকে। আপনার বাড়ির ছাদ, বারান্দা বা সামনের এক চিলতে জায়গায় লাগানো প্রতিটি গাছ এই তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। বৃক্ষমেলা আপনাকে সেই সুযোগটিই করে দিচ্ছে।

২. কার্বন শোষণ: গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে—এটা আমরা সবাই জানি। জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রধান খলনায়ক এই কার্বন। আপনার লাগানো প্রতিটি গাছ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শুষে নিয়ে এই লড়াইয়ে একজন নীরব সৈনিকের ভূমিকা পালন করে।

৩. জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়: একটি ফলের গাছ শুধু আপনাকে ফল দেয় না, এটি পাখি, মৌমাছি আর প্রজাপতির মতো অসংখ্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। শহুরে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রতিটি বাড়ির গাছপালা এক একটি ছোট অভয়ারণ্য। এই মেলায় দেশি-বিদেশি হাজারো প্রজাতির গাছের সমাহার থাকায় আপনি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারছেন।

মেলার ভেতরে কী নেই!

মেলায় ঘুরতে থাকলে মনে হবে, এ যেন এক উদ্ভিদ জাদুঘর। প্রতিটি স্টল যেন সবুজের এক একটি ভিন্ন জগৎ।

  1. ফলের সম্ভার: দেশি আম, কাঁঠাল, জামরুল, আমলকীর পাশাপাশি এখানে মিলবে থাইল্যান্ড থেকে আনা চিয়াংমাই, চাকাবাত, ব্রুনেই কিং-এর মতো অদ্ভুত নামের সব আম। আরও আছে রাম্বুটান, লঙ্গান, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন বা মিসরীয় ডুমুর। একটি নার্সারির অভিজ্ঞ মালিকের মতে, ছাদবাগানের উপযোগী হাইব্রিড জাতের গাছের প্রতিই শহরবাসীর আগ্রহ বেশি। ২০০ টাকার ছোট চারা থেকে শুরু করে ফলসহ ৩০ হাজার টাকা দামের বড় গাছও পাওয়া যাচ্ছে।
  2. মসলার বাগান: এলাচি, দারুচিনি, গোলমরিচ বা তেজপাতার গাছ দেখেছেন কখনও? এখানে ৩০০ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যেই আপনি নিজের রান্নাঘরের জন্য একটি জ্যান্ত মসলার বাগান তৈরি করে ফেলতে পারেন।
  3. সৌন্দর্যের ছোঁয়া: যারা ঘরে বা বারান্দায় সবুজের স্নিগ্ধতা চান, তাদের জন্য আছে ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট, অর্কিড আর ইনডোর প্ল্যান্টের বিশাল সংগ্রহ। মুক্তাগাছা থেকে আসা একটি নার্সারি তো রীতিমতো গ্রিনহাউসের আদলে তাদের পসরা সাজিয়েছে, যা দেখতেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
  4. ফুলের হাসি: গোলাপ, জবা, জুঁই, বেলি, হাসনাহেনার মতো পরিচিত ফুলের পাশাপাশি রয়েছে শত শত নাম না জানা রঙিন ফুল। মেলার বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের সুবাস আর রঙের খেলা যেকোনো অবসাদগ্রস্ত মনকে চাঙ্গা করে তুলতে বাধ্য।

শুধু গাছই নয়, সাথে মিলছে বীজ, সব ধরনের সার, মাটি এবং গাছ লাগানোর অন্যান্য উপকরণও। অর্থাৎ, বৃক্ষরোপণের জন্য আপনার যা যা প্রয়োজন, তার সবই পাবেন এক ছাদের নিচে।

শেষ কথা: আপনার সবুজ উদ্যোগটি আজই শুরু হোক

জাতীয় বৃক্ষমেলা কেবল একটি বার্ষিক আয়োজন নয়। এটি একটি আন্দোলন, একটি সুযোগ এবং একটি অনুস্মারক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের বা বড় কোনো সংস্থার নয়; এই দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের সকলের।

একটি গাছ লাগানো হয়তো সমুদ্রের তীরে এক ফোঁটা জল ফেলার মতো মনে হতে পারে। কিন্তু কোটি কোটি মানুষ যখন এক ফোঁটা করে জল ফেলে, তখন নতুন সমুদ্র তৈরি হয়। জলবায়ু পরিবর্তন-এর মতো ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের প্রত্যেকের ছোট ছোট সবুজ উদ্যোগগুলোই একত্রিত হয়ে একটি বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

আপনার জন্য একটি প্রশ্ন :

আপনি কি এবারের বৃক্ষমেলায় গিয়েছেন? কিংবা যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন? কমেন্টে আমাদের জানান, এই পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে আপনি কোন গাছটি বেছে নেবেন আপনার সঙ্গী হিসেবে।

পরিবেশগত পরিকল্পনা, জলবায়ু অভিযোজন বা সবুজ প্রকল্প নিয়ে কোনো 전문 পরামর্শের প্রয়োজন হলে, আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আসুন, একটি সবুজ ও সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ