একটু চোখ বন্ধ করে কক্সবাজারের কথা ভাবুন তো। কী দেখতে পান? бескраন্ত সমুদ্র, গর্জন করা ঢেউ, আর সোনালী বালির সৈকত, তাই না? এই ছবিটা আমাদের সবার চেনা। কিন্তু চোখ খুললেই আরেকটা ছবি সামনে আসে, যা হয়তো আমরা এড়িয়ে যেতে চাই: সারি সারি হোটেল, অপরিকল্পিত দালানকোঠা আর দূষণের ক্রমবর্ধমান চিহ্ন। কক্সবাজার বাঁচানোর লড়াই
যে কক্সবাজার তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত, সেই শহরটিই আজ অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে ধুঁকছে। এটি এখন শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনার এক জীবন্ত পরীক্ষাক্ষেত্র। ঠিক এই সংকটময় মুহূর্তে, একদল স্বপ্নদ্রষ্টা স্থপতি এগিয়ে আসছেন একটি সমাধান খুঁজতে। আর সেই সমাধানের খোঁজে আয়োজিত হতে চলেছে ‘ডিসকোর্স বাই দ্য শোর: ট্যুরিজম আর্কিটেকচার সামিট-২০২৫’। কক্সবাজার বাঁচানোর লড়াই
সমস্যার নাম ‘উন্নয়ন’, যা আসলে বিনাশ
ঘটনাটা অনেকটা গাছের ডাল কেটে সেই ডালেই বসার মতো। পর্যটকদের থাকার জন্য আমরা কক্সবাজারে গড়ে তুলেছি পাঁচ শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট আর গেস্টহাউস। তাদের খাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে কয়েকশ রেস্তোরাঁ। কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞের পেছনে কোনো পরিকল্পনা ছিল কি?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরটি হলো ‘না’। এর ফলাফল?
১. দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: হোটেল ও রেস্তোরাঁর বর্জ্য সরাসরি চলে যাচ্ছে সমুদ্র আর পাশের বাঁকখালী নদীতে। ভাবুন, যে সমুদ্রের জলে গা ভাসাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে যায়, সেই জলকেই আমরা প্রতিদিন বিষাক্ত করছি।
২. হঠাৎ বন্যা: সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় এখন এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই শহরের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পানিতে ডুবে যায়। যে শহর সমুদ্রকে আলিঙ্গন করে বেঁচে আছে, সে আজ সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যাচ্ছে—এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে?
৩. পরিবেশগত বিপর্যয়: এই অপরিকল্পিত নগরায়ন কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে, বালিয়াড়ির স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে কক্সবাজার本来ই ঝুঁকিতে আছে, তার উপর এই মানবসৃষ্ট বিপর্যয় সেই ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। কক্সবাজার বাঁচানোর লড়াই
পর্যটকদের জন্য নতুন কোনো বিনোদনের ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে না। সেই একই সৈকত, একই ধরনের হোটেল—এই চক্রে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পও যেন একঘেয়ে হয়ে পড়ছে।
আশার আলো: ট্যুরিজম আর্কিটেকচার সামিট
এই ধূসর ক্যানভাসে এক ঝলক রঙের মতো আসছে স্থপতিদের এই সম্মেলন। আগামী ১১ ও ১২ জুলাই কক্সবাজারের পরিবেশবান্ধব ‘মারমেইড বিচ রিসোর্টে’ এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এটি নিছক কোনো আলোচনা সভা নয়, বরং কক্সবাজারকে বাঁচানোর একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
সম্মেলনের নেতৃত্বে থাকছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম। তাঁর তত্ত্বাবধানে দেশের সেরা স্থপতিরা একত্রিত হবেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য হলো—স্থাপত্যকে ব্যবহার করে কীভাবে টেকসই পর্যটন গড়ে তোলা যায়, যা একই সাথে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করবে এবং কক্সবাজারের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরবে।
সম্মেলনে কী কী থাকছে?
- প্রথম দিন: সম্মেলন শুরু হবে ‘ইকো ট্যুরিজম এবং স্থাপত্যচর্চায় টেকসইতা’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যানেল আলোচনার মাধ্যমে। এখানে স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম, খোন্দকার হাসিবুল কবির ও এহসান খানের মতো ব্যক্তিত্বরা তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দর্শন তুলে ধরবেন। বিকেলে সাতজন স্থপতি তাঁদের উদ্ভাবনী স্থাপত্য ধারণা উপস্থাপন করবেন। দিনের শেষে থাকছে একটি ব্যতিক্রমী আয়োজন—’গাইডেড সান-সেট মেডিটেশন’, যেখানে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে নকশার অনুপ্রেরণা খোঁজা হবে।
- দ্বিতীয় দিন: আরও দশজন স্থপতি দুটি সেশনে তাঁদের প্রকল্প এবং ধারণাগুলো তুলে ধরবেন। সম্মেলন শেষ হবে একটি ওপেন ফ্লোর প্যানেল আলোচনার মাধ্যমে, যেখানে উপস্থিত সবাই নিজেদের মতামত জানাতে পারবেন। সবশেষে মেরিনা তাবাসসুম পুরো সম্মেলনের সারমর্ম তুলে ধরে ভবিষ্যতের একটি রূপরেখা দেবেন।
আয়োজক প্রতিষ্ঠান মারমেইড বিচ রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল হক চৌধুরীর কথায়, “কক্সবাজার এখনো বিকাশমান একটি অঞ্চল, পরিবেশবান্ধব কক্সবাজার গড়তে এই সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।” তাঁর মতে, এই সম্মেলন পর্যটননির্ভর উন্নয়নে স্থাপত্যের ভূমিকাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে।
কেন এই সম্মেলনটি গুরুত্বপূর্ণ?
এই সম্মেলনটি শুধু কিছু দালানকোঠার নকশা নিয়ে আলোচনার জন্য নয়। এর গুরুত্ব আরও গভীর।
- দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: এটি প্রমাণ করে যে স্থাপত্য মানে শুধু ইট-সিমেন্টের কাঠামো নয়। একটি অঞ্চলের পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার সাথে মিলিয়ে কীভাবে একটি স্থাপনা তৈরি হতে পারে, সেই দর্শনটিই এখানে মূল।
- জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই: উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য টেকসই স্থাপত্য শুধু বিলাসিতা নয়, এটি টিকে থাকার লড়াই। সঠিক নকশা ও নির্মাণশৈলী সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে।
- স্থানীয় জ্ঞানের সন্মান: এই সম্মেলনে “স্থানীয় বাস্তবতাভিত্তিক স্থাপত্যচর্চার” উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এর অর্থ হলো, বিদেশের কোনো ঝকঝকে শহরের নকশা অন্ধভাবে নকল না করে, কক্সবাজারের নিজস্ব আবহাওয়া, উপকরণ এবং সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে নতুন কিছু তৈরি করা।
শেষ কথা
‘ডিসকোর্স বাই দ্য শোর’ সম্মেলনটি একটি বাতিঘর হতে পারে। এটি আমাদের শেখাতে পারে যে কীভাবে উন্নয়ন এবং প্রকৃতি হাতে হাত রেখে চলতে পারে। তবে আসল চ্যালেঞ্জ শুরু হবে সম্মেলনের পর। স্থপতিদের এই চমৎকার ধারণাগুলো কি শুধুই আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তবে রূপ নেবে?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে নীতিনির্ধারক, ডেভেলপার এবং আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সদিচ্ছার মধ্যে। কক্সবাজারকে যদি সত্যিই ভালোবাসেন, তাহলে এর পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বও আমাদের সবার। এই সম্মেলন সেই দায়িত্বের কথাই আমাদের মনে করিয়ে দিতে আসছে।
আপনার ভাবনা কী?
আপনি কি মনে করেন, স্থাপত্যের মাধ্যমে কক্সবাজারের পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব? এই বিষয়ে আপনার মতামত কমেন্ট সেকশনে জানান।
আপনি যদি পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন বা টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে থাকেন এবং এই ধরনের প্রকল্পে আগ্রহী হন, তাহলে আসুন, আমরা একসাথে একটি সবুজ ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে আলোচনা করি।
অবশ্যই! আপনার অনুরোধ অনুযায়ী নিউজ অ্যানালাইসিস পোস্টটির জন্য আকর্ষণীয় শিরোনাম, মেটা ডেসক্রিপশন, ফেসবুক পোস্ট এবং একটি ভয়েস স্ক্রিপ্ট নিচে দেওয়া হলো।