24.9 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুলাই ৮, ২০২৫
spot_img

প্রতিশ্রুতি ভেঙে চট্টগ্রামের ফুসফুসকে হত্যা করা হচ্ছে?

নগরীর কোলাহলের মাঝে এক টুকরো সবুজ, এক চিলতে খোলা আকাশ আর বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা—একটি পার্ক বলতে আমরা এটাই বুঝি। কিন্তু সেই পার্ক যদি নিজেই বাণিজ্যিক আগ্রাসনের শিকার হয়, তখন তাকে কী বলা যায়? চট্টগ্রামের বিপ্লব উদ্যানের দিকে তাকালে এই প্রশ্নটিই আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মেয়র বদলায়, প্রতিশ্রুতি বদলায়, কিন্তু উদ্যানের বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টা বদলায় না। চট্টগ্রামের ফুসফুসকে হত্যা

সেই পুরোনো গল্পই যেন নতুন করে মঞ্চস্থ হচ্ছে চট্টগ্রামের বিপ্লব উদ্যানে। নগরীর ব্যস্ততম ২ নম্বর গেট এলাকার এই এক একর সবুজ ভূমিকে ঘিরে আবারও শুরু হয়েছে স্থাপনা নির্মাণের আয়োজন। আর এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে বর্তমান নগর কর্তৃপক্ষ যেন তাদের পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই হাঁটছেন, যা নগরবাসী ও পরিবেশবাদীদের কপালে নতুন করে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। চট্টগ্রামের ফুসফুসকে হত্যা

প্রতিশ্রুতির ভাঙা-গড়া আর একটি নতুন চুক্তি

ঘটনার পরম্পরা অনেকটা নাটকের মতো। গত বছরের শেষ দিকে বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর বিপ্লব উদ্যান পরিদর্শনে গিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখানে আর কোনো নতুন স্থাপনা হবে না। পূর্ববর্তী মেয়রের আমলে শুরু হওয়া নির্মাণাধীন অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলার নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি, যা বাস্তবায়িতও হয়েছিল। নগরবাসী ভেবেছিল, যাক, উদ্যানটি এবার হয়তো বাঁচবে।

কিন্তু সেই আশা বেশিদিন টিকল না। কয়েকমাস ঘুরতে না ঘুরতেই শোনা গেল নতুন সুর। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন একটি বেসরকারি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সাথে ২৫ বছরের জন্য চুক্তি করেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি উদ্যানে বিদ্যমান একতলা স্থাপনাকে চারতলা পর্যন্ত বাড়াতে পারবে এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। চট্টগ্রামের ফুসফুসকে হত্যা

অর্থাৎ, যে বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, সেই একই পথে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন বর্তমান নগর কর্তৃপক্ষ। এটি শুধু একটি চুক্তি নয়, এটি নগরবাসীর সাথে, বিশেষ করে গণশুনানিতে অংশ নিয়ে যারা উদ্যান রক্ষার পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাদের সাথে এক ধরনের প্রতারণা।

সবুজ যখন সংখ্যার নিচে চাপা পড়ে

বিপ্লব উদ্যান যে শুধু নামেই ‘উদ্যান’ হয়ে টিকে আছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একটি গবেষণা। তাদের জরিপ অনুযায়ী, এই উদ্যানের ৫৫ শতাংশই এখন কংক্রিটের জঞ্জাল!

ভাবুন একবার, বাংলাদেশের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী একটি উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কংক্রিট অবকাঠামো থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই হার মাত্র ২ শতাংশ। আর সেখানে বিপ্লব উদ্যানে কংক্রিটের পরিমাণ ৫৫ শতাংশ! এটি শুধু আইন বা নীতির লঙ্ঘন নয়, এটি নগরীর ফুসফুসের উপর একটি নির্দয় আক্রমণ।

এই পরিস্থিতিতে নতুন করে চারতলা ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়াটা অনেকটা আইসিইউতে থাকা রোগীর অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেওয়ার মতো। এর মাধ্যমে নগরীর পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার সক্ষমতাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে।

উন্নয়ন, বাণিজ্য নাকি পরিবেশ?

সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের। বলা হচ্ছে, আগে যেখানে দোকানগুলো থেকে বছরে মাত্র এক লাখ টাকা পাওয়া যেত, নতুন চুক্তির ফলে এখন ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি আকর্ষণীয় আর্থিক প্রস্তাব।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি শহরের ফুসফুসের মূল্য কি টাকায় পরিমাপ করা যায়? যে সবুজ ছায়া নগরবাসীকে তীব্র গরম থেকে বাঁচায়, যে উন্মুক্ত স্থান শিশুদের খেলার সুযোগ করে দেয়, যে গাছপালা দূষিত বাতাসকে বিশুদ্ধ করে—তার আর্থিক মূল্য কত?

নগর–পরিকল্পনাবিদদের মতে, এই ধরনের বাণিজ্যিকীকরণ একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। নগরীতে মূলত সবুজ স্থান এবং উন্মুক্ত পরিসর কমছে। জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে শহরগুলো যখন ‘হিট আইল্যান্ড’-এ পরিণত হচ্ছে, তখন সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হলো সবুজ এলাকা বাড়ানো, কমানো নয়। কিন্তু এখানে ঘটছে ঠিক তার উল্টোটা। আরবান লাউঞ্জ, কফিশপ, ডিজিটাল স্ক্রিন, বিলবোর্ড—এসব আধুনিকতার নামে উদ্যানের মূল আত্মাকেই হত্যা করা হচ্ছে।

একটি দুষ্টচক্রের পুনরাবৃত্তি

বিপ্লব উদ্যানের এই দুর্ভাগ্য নতুন নয়। গত সাত বছরে তিনটি ভিন্ন মেয়রের আমলে তিনটি চুক্তি হয়েছে, আর প্রতিবারই লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যিকীকরণ। একজন চুক্তি করেন, সমালোচনার মুখে বা আদালতের নির্দেশে তা বাতিল হয় বা ভেঙে ফেলা হয়, আরেকজন এসে আবার একই উদ্যোগ নেন। এই দুষ্টচক্র প্রমাণ করে, নগর কর্তৃপক্ষের কাছে নগরের পরিবেশ রক্ষার চেয়ে বাণিজ্যিক মুনাফা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান মেয়রের পূর্বসূরিদের একজন দোতলা ভবন বানিয়েছিলেন, যা পরবর্তী প্রশাসক ভেঙে দিয়েছিলেন। আরেকজন মেয়রের চুক্তি তো আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেই ইতিহাস জেনেও বর্তমান কর্তৃপক্ষ যখন একই পথে হাঁটেন, তখন তাকে স্রেফ ভুল বলা চলে না, এটি নগরীর সবুজ ধ্বংসের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

শেষ কথা

বিপ্লব উদ্যান আজ একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু একটি পার্ক নয়, এটি নগর কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও दूरদর্শিতার একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। ২৫ বছরের জন্য একটি বাণিজ্যিক চুক্তি করে সাময়িক কিছু রাজস্ব হয়তো বাড়ানো যাবে, কিন্তু এর বিনিময়ে নগরী যা হারাবে, তা আগামী শত বছরেও পূরণ করা সম্ভব হবে না।

স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে দোকান মালিক সমিতি পর্যন্ত সবাই এই নতুন চুক্তির বিরোধিতা করছেন। এখন দেখার বিষয়, নগর কর্তৃপক্ষ কি জনগণের কণ্ঠস্বর শুনবে, নাকি বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে নতি স্বীকার করে একটি সবুজ ইতিহাসকে কংক্রিটের নিচে কবর দেবে।

আপনার ভাবনা কী?

আপনি কি মনে করেন, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য একটি পার্কের বাণিজ্যিকীকরণ মেনে নেওয়া যায়? এই ধরনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আমাদের করণীয় কী?

আপনি যদি পরিবেশগত সংকট মোকাবেলা বা টেকসই নগর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন, আসুন, আমরা একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ার লক্ষ্যে একসাথে আওয়াজ তুলি। আপনার পরিকল্পনা ও ভাবনা নিয়ে আলোচনার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ