24.9 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুলাই ৮, ২০২৫
spot_img

কাগজে ১০০ কিমি পরিষ্কার, বাস্তবে ৮টি খালই মৃতপ্রায়!

একসময় যে খালগুলো ছিল শহরের প্রাণ, শিরা-উপশিরার মতো বয়ে নিয়ে যেত অতিরিক্ত পানি, সেই খালগুলো আজ নিজেই মুমূর্ষু। কোথাও আবর্জনার আস্তরণে ঢাকা পড়ে তাদের অস্তিত্বই বিলীন, কোথাও আবার বর্জ্য জমে জন্মেছে আগাছার জঙ্গল। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, এটি কোনো খাল নয়, যেন শহরের এক পরিত্যক্ত ভাগাড়। বাস্তবে ৮টি খালই মৃতপ্রায়

এটিই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকার বেশিরভাগ খালের বর্তমান চিত্র। এই চিত্র শুধু একটি নগর কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে তুলে ধরে না, এটি আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতা, পরিবেশ সংকট এবং আসন্ন জলবায়ু পরিবর্তন-এর ঝুঁকির এক জীবন্ত দলিল। বাস্তবে ৮টি খালই মৃতপ্রায়

কাগজে-কলমে আর বাস্তবে বিস্তর ফারাক

বিগত বর্ষায় মাত্র এক রাতের বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা যখন কোমর পানিতে ডুবে গিয়েছিল, নগরবাসী যখন চরম দুর্ভোগে পড়েছিল, তখন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছিল। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, ২৯টি খালের ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা দখলমুক্ত করে পানির প্রবাহ সৃষ্টি করা হয়েছে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, খোদ সিটি করপোরেশনেরই অন্য একটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এই ২৯টি খালের মোট দৈর্ঘ্যই যেখানে ৯৮ কিলোমিটার, সেখানে ১০০ কিলোমিটারের বেশি পরিষ্কার করা হলো কীভাবে? এই তথ্যের গরমিলই বলে দেয়, মাঠের বাস্তবতার সাথে দাপ্তরিক ঘোষণার সংযোগ কতটা দুর্বল। এই ধরনের অসামঞ্জস্যতা কেবল স্বচ্ছতার অভাবকেই নির্দেশ করে না, এটি সংকট মোকাবেলায় আন্তরিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাস্তবে ৮টি খালই মৃতপ্রায়

মাঠের চিত্র: ৮টি খাল যখন আবর্জনার স্তূপ

একটি গণমাধ্যমের সরেজমিন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরও ভয়াবহ চিত্র। ডিএনসিসি এলাকার ১৩টি খালের মধ্যে ৮টির অবস্থাই করুণ। মিরপুরের আরামবাগ খাল যেন প্লাস্টিক, পলিথিন আর কর্কশিটের এক স্থায়ী প্রদর্শনী। বর্জ্যের কারণে সেখানে পানির অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া ভার। স্থানীয়রা বলছেন, দীর্ঘদিন তারা কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে দেখেননি।

একই অবস্থা রূপনগর, বাইশটেকি, কল্যাণপুর ও রামচন্দ্রপুর খালের। দোকানিরা বলছেন, চার-পাঁচ মাস আগে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসেছিলেন বটে, কিন্তু তাদের চিরুনি আকৃতির কাঁটা দিয়ে আবর্জনা তোলার পদ্ধতি অনেকটা ‘দায়সারা গোছের’। এতে খালের উপরিভাগের কিছু আবর্জনা হয়তো ওঠে, কিন্তু গভীরে জমে থাকা বর্জ্যের স্তর আগের মতোই থেকে যায়। ফলে, খালের প্রবাহ সংকুচিত হয়ে একটি সরু নালার আকার নিয়েছে। এই মৃতপ্রায় খালগুলোই সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তবে আশার কথাও আছে। সাংবাদিক কলোনি, বাউনিয়া, ইব্রাহিমপুরের মতো ৫টি খাল তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার দেখা গেছে। বিশেষ করে, বাউনিয়া খালে নৌবাহিনীকে দিয়ে খননকাজ করানোর পর সেখানে পানির প্রবাহ ফিরেছে। এটি প্রমাণ করে, সঠিক উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিলে খালগুলোকে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু বিচ্ছিন্ন কিছু সাফল্য সামগ্রিক ব্যর্থতাকে ঢাকতে পারে না।

সংকটের গভীরের সংকট: পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন

এই বর্জ্যে ভরা খালগুলো শুধু জলাবদ্ধতার কারণ নয়। এর পরিবেশগত প্রভাব আরও অনেক গভীর এবং সুদূরপ্রসারী।

১. পরিবেশগত বিপর্যয়: এই খালগুলো এখন মশা এবং রোগজীবাণুর আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। খালের পানিতে ফেলা শিল্প ও গৃহস্থালি বর্জ্যের বিষাক্ত রাসায়নিক ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকেও দূষিত করছে। খালের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, যা নগরীর জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটি আমাদের পরিবেশ-এর উপর একটি নীরব আক্রমণ।

২. জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বৃদ্ধি: বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই সতর্ক করছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে আবহাওয়ার আচরণ আরও চরম হবে। অর্থাৎ, অল্প সময়ে অতি ভারী বৃষ্টির প্রবণতা বাড়বে। ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরের জন্য এই পরিবর্তন এক অশনি সংকেত। শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম হলো এই খালগুলো। যখন এই খালগুলোই বর্জ্যে বন্ধ থাকে, তখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আকস্মিক বন্যা বা প্লাবন থেকে শহরকে রক্ষা করার আর কোনো উপায় থাকে না। একটি সচল খাল নেটওয়ার্ক হলো জলবায়ু সহনশীল (Climate Resilient) শহর গড়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত।

কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, মানুষজনই খালে ময়লা ফেলে, পয়োবর্জ্যের লাইনও খালের সাথে যুক্ত। প্রতিবছর খাল রক্ষণাবেক্ষণে প্রায় শতকোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তার পুরোপুরি ব্যবহার হয় না। এই বক্তব্যগুলো সমস্যার মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করে, কিন্তু সমাধানের পথ দেখায় না।

শেষ কথা: সমাধানের পথ কোথায়?

ঢাকার খালগুলোকে বাঁচানোর লড়াইটি শুধু সিটি করপোরেশনের একার নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।

  1. ধারাবাহিক পরিচ্ছন্নতা: লোক দেখানো বা মৌসুমি অভিযান নয়, সারা বছর ধরে নিয়মিত খাল পরিষ্কার ও খনন করতে হবে।
  2. কঠোর আইন প্রয়োগ: খালে ময়লা ফেলা বা পয়োবর্জ্যের লাইন সংযোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  3. জনসচেতনতা: খালগুলোকে ‘শহরের সম্পদ’ হিসেবে তুলে ধরে নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
  4. বাজেটের সঠিক ব্যবহার: প্রতিবছর বরাদ্দকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ যেন স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকার প্রায় ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল নেটওয়ার্ককে পুনরুদ্ধার করার যে মহাপরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে, তা যদি শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই শহর সামান্য বৃষ্টিতেই অচল হয়ে পড়বে। এই খালগুলো ঢাকার হৃৎপিণ্ড। এই হৃৎপিণ্ড সচল না থাকলে পুরো শহরই একদিন থেমে যাবে।

আপনার মতামত কী?

আপনার এলাকার খালের অবস্থা কেমন? এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আপনি যদি টেকসই নগর ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত ঝুঁকি নিরসন বা জলবায়ু সহনশীল প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন, তবে আসুন, একটি স্বাস্থ্যকর ও বাসযোগ্য শহর গড়ার সংলাপে যোগ দিই। আপনার ভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ