গণশৌচাগার বা পাবলিক টয়লেট—শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে কী ভাসে? সম্ভবত অস্বস্তি, অপরিচ্ছন্নতা আর এড়িয়ে চলার প্রবণতা। জনবহুল এই দেশে বিষয়টি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক কঠিন বাস্তবতা হলেও, সামাজিক পরিমণ্ডলে এটি এক প্রায় নিষিদ্ধ বা অনালোচিত অধ্যায়। এই নীরবতা ও অস্বস্তির অচলায়তন ভাঙতেই এক অভিনব উদ্যোগ নিয়ে এসেছে ওয়াটারএইড বাংলাদেশ। তাদের ‘পথে হলো দেখা’ ক্যাম্পেইনটি শুধু কিছু পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান নয়, এটি শিল্পকে হাতিয়ার করে এক নীরব সামাজিক বিপ্লবের সূচনা, যার ঢেউ লেগেছে আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন-এর মতো গভীর আলোচনাতেও।
যেখানে কথা বলাই ছিল বারণ
দীর্ঘদিনের অপ্রাপ্তি আর নেতিবাচক অভিজ্ঞতা জনপরিসরে স্যানিটেশন নিয়ে কথা বলাটাকে একপ্রকার সামাজিক অপরাধে পরিণত করেছে। ওয়াটারএইড ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত হেনেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, ইট-সিমেন্টের কাঠামো তৈরির আগে মানুষের মনের ভেতরের কাঠামোটা নাড়া দেওয়া জরুরি। আর সেই কাজটি করার সবচেয়ে মানবিক ও শক্তিশালী উপায় হলো শিল্প।
‘পথে হলো দেখা’ ক্যাম্পেইনের মূল লক্ষ্য ছিল গণশৌচাগার নিয়ে মানুষের ভাবনাকে বাইরে নিয়ে আসা, তাদের অভিজ্ঞতাকে ভাষা দেওয়া এবং একটি স্বাস্থ্যকর নাগরিক জীবনের জন্য এর গুরুত্বকে সামনে আনা। এই মহৎ উদ্দেশ্যে তারা বেছে নেয় তিনটি মাধ্যম: চিত্রাঙ্কন, গল্প লেখা এবং মোবাইল ভিডিও।
- শিশুদের চোখে স্বপ্নের শৌচাগার: ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা তাদের কল্পনার রঙে এঁকেছে পাবলিক টয়লেট। সেই ছবিগুলোতে শুধু পরিচ্ছন্নতাই ছিল না, ছিল সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এক মানবিক আবেদন। প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য র্যাম্প, উজ্জ্বল আলো-বাতাস, হাত ধোয়ার সুন্দর বেসিন, এমনকি দরজায় লেখা ‘স্বাগতম’ বার্তা আর পাশে সাজানো ফুলের টব—এই শিশুরা আমাদের দেখিয়েছে, একটি শৌচাগার কতটা মানবিক ও সুন্দর হতে পারে।
- তরুণদের কলমে অব্যক্ত যন্ত্রণা ও আশা: ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের গল্পে উঠে এসেছে পাবলিক টয়লেটের কঠিন বাস্তবতা। কোনো নারী লিখেছেন মাসিক চলাকালীন একটি ব্যবহারযোগ্য টয়লেট না পাওয়ার অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। কোনো তরুণ লিখেছেন, ঘরের বাইরে বেরোনোর আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি না খেয়ে থাকার যন্ত্রণা, যা আমাদের অনেকেরই চেনা অভিজ্ঞতা। আবার কেউ শুনিয়েছেন শহরের কোণে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া একটি পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের গল্প, যা তার নাগরিক জীবনের প্রতি নতুন করে আশা জাগিয়েছে।
- ভিডিওতে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য তৈরি ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা তুলে ধরেছেন টয়লেট ব্যবহারের বাস্তব চিত্র, নানা সুবিধা-অসুবিধা এবং এমন সব বার্তা যা আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়, ভাবতে বাধ্য করে।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রায় চার শতাধিক মানুষ তাদের ভাবনা প্রকাশ করেছেন। এটি প্রমাণ করে, সুযোগ পেলে মানুষ কথা বলতে চায়, নিজেদের চাহিদা ও স্বপ্নের কথা জানাতে চায়।
শুধু স্যানিটেশন নয়, এর সাথে জড়িয়ে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
প্রথম দৃষ্টিতে এই শিল্পকর্ম বা গল্পের সাথে পরিবেশ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের সংযোগ খুঁজে পাওয়া কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু সংযোগটি অত্যন্ত গভীর এবং আজকের বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।
১. সরাসরি পরিবেশ দূষণ রোধ: একটি অস্বাস্থ্যকর ও অব্যবস্থাপূর্ণ শৌচাগারের পয়ঃবর্জ্য কোথায় যায়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা সরাসরি আমাদের ড্রেন, নালা হয়ে নদী ও জলাশয়ে মেশে। এই বর্জ্য মাটি ও পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে, যা পানিবাহিত রোগ ছড়ানোর পাশাপাশি জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে। যখন ওয়াটারএইডের মতো প্রতিষ্ঠান একটি আধুনিক, সুপরিচালিত শৌচাগার স্থাপন করে, তখন তারা শুধু স্বাস্থ্যকর পরিবেশই নিশ্চিত করে না, তারা সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের নদী ও মাটিকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে। এটি নগর পরিবেশ রক্ষার এক প্রত্যক্ষ উদাহরণ।
২. জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে সহনশীলতা:জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো তত্ত্বীয় বিষয় নয়, এটি আমাদের রূঢ় বাস্তবতা। ঘন ঘন বন্যা, অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা আমাদের নিত্যসঙ্গী। একটি সাধারণ বন্যা বা জলাবদ্ধতার সময় কী ঘটে? শত শত অনিরাপদ ল্যাট্রিন ও সেপটিক ট্যাঙ্ক ডুবে যায়। পয়ঃবর্জ্য সরাসরি বন্যার পানির সাথে মিশে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয় তৈরি করে।
‘পথে হলো দেখা’ ক্যাম্পেইনটি যখন একটি উন্নত ও স্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেটের দাবিকে জোরালো করে, তখন এটি প্রকারান্তরে একটি ‘জলবায়ু সহনশীল’ স্যানিটেশন ব্যবস্থার কথাই বলে। একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত শৌচাগার এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যা বন্যা বা জলাবদ্ধতার মাঝেও পয়ঃবর্জ্যকে পরিবেশে ছড়াতে দেয় না। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার (Adaptation) একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
শেষ কথা: প্রশ্ন তোলার সাহসটাই সবচেয়ে বড় অর্জন
ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কমিউনিকেশনস কো–অর্ডিনেটর প্লাবন গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘এই প্রশ্ন তোলার সাহসটাই সবচেয়ে বড় অর্জন।’ রাস্তায় বের হলে একটি ব্যবহারযোগ্য টয়লেট পাওয়া যাবে কিনা—এই প্রশ্নটি যখন একজন নাগরিক সাহসের সাথে করতে পারেন, তখন থেকেই আসল পরিবর্তন শুরু হয়।
‘পথে হলো দেখা’ ক্যাম্পেইনটি আমাদের শিখিয়েছে যে, শিল্প শুধু সৌন্দর্যচর্চা নয়, এটি সামাজিক পরিবর্তনের এক শক্তিশালী অনুঘটক। এটি একটি ‘অস্বস্তিকর’ বিষয়কে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে এবং দেখিয়েছে যে একটি পরিচ্ছন্ন শৌচাগার শুধু একটি সুবিধা নয়, এটি নাগরিকের অধিকার। আর এই অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আমরা একটি স্বাস্থ্যকর সমাজ, দূষণমুক্ত পরিবেশ এবং জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
আপনার অভিজ্ঞতা কী?
গণশৌচাগার নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কেমন? আপনি কি মনে করেন এই ধরনের সৃজনশীল উদ্যোগ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে? আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে জানান।
টেকসই স্যানিটেশন, পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা প্রাতিষ্ঠানিক সমাধানের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন, একটি সুস্থ ও সবুজ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করি।
অবশ্যই, আপনার সর্বশেষ পোস্টটির জন্য নিচে ১০টি আকর্ষনীয় শিরোনাম, একটি মেটা ডেসক্রিপশন, ফেসবুক পোস্ট এবং একটি ৩০ সেকেন্ডের ভয়েস স্ক্রিপ্ট দেওয়া হলো।