25.5 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুলাই ৮, ২০২৫
spot_img

যে শহরে সবাই বেড়াতে যায়, সে শহর আজ পানির নিচে

টানা বৃষ্টির শব্দ এখন কক্সবাজারবাসীর কাছে আর রোমান্টিক নয়, বরং এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। গত চার দিনের অবিরাম বর্ষণ আর উত্তরের পাহাড়ি ঢলে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহরটি এখন এক বিশাল জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। ১২৪টি গ্রামের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, এমনকি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোও পানির নিচে। এটি কি শুধুই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ? নাকি আমাদের নিজেদের হাতে তৈরি করা এক সংকটের অসহায় আত্মসমর্পণ? শহর আজ পানির নিচে

আজকের এই বিশ্লেষণ শুধু ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান তুলে ধরার জন্য নয়, বরং এই বিপর্যয়ের পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করা এবং এর সাথে পরিবেশজলবায়ু পরিবর্তন-এর গভীর সম্পর্ক উন্মোচন করার একটি প্রচেষ্টা। শহর আজ পানির নিচে

বিপর্যয়ের ভয়াবহ চিত্র: যখন সংখ্যাগুলো কথা বলে

পরিসংখ্যানগুলো আঁতকে ওঠার মতোই। কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ৩০ ঘণ্টায় ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে—যা এক কথায় অস্বাভাবিক। এই বিপুল জলরাশি এবং পাহাড়ি ঢল বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর কূল ছাপিয়ে এক ভয়াল বন্যার সৃষ্টি করেছে। শহর আজ পানির নিচে

  1. উপজেলাভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতি: চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ এবং কুতুবদিয়া—প্রায় প্রতিটি উপজেলাই কমবেশি প্লাবিত। টেকনাফে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা, যেখানে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। উখিয়ায় স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা মিলিয়ে পানিবন্দী প্রায় ২০ হাজার।
  2. মানবিক সংকট: হাজার হাজার পরিবারে রান্না বন্ধ। আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে শত শত পরিবার। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন এলাকায় সাগর উত্তাল থাকায় ত্রাণ পৌঁছানোও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এটি শুধু অবকাঠামোগত বিপর্যয় নয়, এটি এক গভীর মানবিক সংকট।

জেলা প্রশাসন জরুরি ত্রাণ সহায়তা (১৫ মেট্রিক টন চাল, শুকনা খাবারের প্যাকেট) দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, যা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এই তাৎক্ষণিক সহায়তা কি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের বিকল্প হতে পারে?

প্রকৃতির রোষের পেছনে মানুষের হাত: আসল কারণ কী?

কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার একটি মন্তব্য এই পুরো সংকটের সারমর্ম তুলে ধরে: “পাহাড় কেটে মাটি ফেলায় নালাগুলো ভরে গেছে, ফলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।”

এই একটি বাক্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রকৃতির এই রুদ্ররূপের পেছনে আমাদের নিজেদের দায় কতটা। চলুন, কারণগুলো একটু ভেঙে দেখি:

১. পাহাড় কাটা: কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয়ের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হয়েছে। পাহাড়গুলো প্রাকৃতিক স্পঞ্জের মতো কাজ করে, যা বৃষ্টির পানি শোষণ করে ধীরে ধীরে নিঃসরণ করে। যখন এই পাহাড়গুলোকেই কেটে ফেলা হয়, তখন বৃষ্টির পানি শোষিত হওয়ার বদলে মাটিসহ তীব্র বেগে নেমে এসে নদ-নদী ও নিষ্কাশন নালা ভরাট করে ফেলে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এটি পরিবেশ ধ্বংসের এক সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।

২. অপরিকল্পিত নগরায়ণ: হোটেল-মোটেল জোন থেকে শুরু করে শহরের অভ্যন্তরীণ সড়ক—সবই এখন পানির নিচে। এর মূল কারণ হলো অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, যা পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রাকৃতিক ঝরনা ও ছড়া দখল করে ভবন নির্মাণ করায় পানি এখন যাওয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না।

৩. নদী দখল ও দূষণ: বাঁকখালী ও মাতামুহুরীর মতো নদীগুলো শুধু পাহাড়ি ঢলের কারণেই স্ফীত হয়নি, বরং বছরের পর বছর ধরে দখল ও দূষণের কারণে এদের নাব্যতা কমে গেছে। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় অতিরিক্ত পানি ধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে, যা বন্যার তীব্রতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন: নীরব ঘাতক

স্থানীয়ভাবে আমরা যে ভুলগুলো করছি, তার সাথে যখন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রভাব যুক্ত হয়, তখন বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যা ঘটছে:

  1. বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন: এখন অল্প সময়ে অতি ভারী বর্ষণ (Extreme Rainfall Event) হচ্ছে। কক্সবাজারের এই ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ঠিক সেই ধরনেরই একটি ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার এই চরম ভাবাপন্নতা দিন দিন বাড়ছে।
  2. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: কুতুবদিয়ায় ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢোকা এবং সেন্ট মার্টিনের গ্রামগুলো প্লাবিত হওয়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ক্রমশই সাগরের কাছে হেরে যাচ্ছে।
  3. ভূমিধসের ঝুঁকি বৃদ্ধি: ভারী বর্ষণ এবং পাহাড় কাটার সম্মিলিত ফল হলো ভূমিধস। জেলা প্রশাসন পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করেছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নিচ্ছে।

সুতরাং, কক্সবাজারের এই বন্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি স্থানীয় পরিবেশ ধ্বংস এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের এক ভয়াবহ ককটেল, যার বিষাক্ত স্বাদ এখন সাধারণ মানুষ ভোগ করছে।

শেষ কথা: সমাধানের পথ কোথায়?

ত্রাণ বিতরণ এবং উদ্ধারকাজ নিঃসন্দেহে জরুরি, কিন্তু এটি কেবল ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগানোর মতো। আসল রোগটি আরও গভীরে। যদি আমরা স্থায়ী সমাধান চাই, তবে আমাদের চিন্তার গোড়া ধরে নাড়া দিতে হবে।

আমাদের অবশ্যই পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে এবং যা কাটা হয়েছে, সেখানে বনায়ন করতে হবে। নদী ও পানি নিষ্কাশনের নালাগুলোকে দখলমুক্ত করে নিয়মিত খনন করতে হবে। যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা করার আগে তার পরিবেশ-গত প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। একইসাথে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

কক্সবাজারের আজকের এই পানিবন্দী দশা শুধু প্রকৃতির রোষ নয়, এটি আমাদের নিজেদের তৈরি করা ভুলের ডুবোচর। এই ডুবোচর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

আপনার মতামত কী?

আপনিও কি মনে করেন যে এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়? আপনার এলাকার পরিবেশগত ঝুঁকিগুলো কী কী এবং তা সমাধানে কী করা যেতে পারে? আপনার মূল্যবান ভাবনা আমাদের জানান।

টেকসই সমাধান, পরিবেশগত ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য কার্যকর কৌশল প্রণয়নে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন, একসাথে একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ