25.5 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুলাই ৮, ২০২৫
spot_img

দূষণের শীর্ষে কুয়েত, ঢাকার স্বস্তি কি সাময়িক?

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ঢাকার আকাশ দেখে যদি মনটা একটু ফুরফুরে লাগে, তার একটা কারণ আছে। গত কয়েকদিনের মতো আজও রাজধানী ঢাকার বাতাস ছিল সহনীয় পর্যায়ে। যারা প্রতিদিন সকালে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) অ্যাপে ঢাকার লাল বা কমলা রঙ দেখতে অভ্যস্ত, তাদের জন্য ৫৫ স্কোর আর সবুজ সঙ্কেত নিঃসন্দেহে এক মনোরম দৃশ্য। দূষণের শীর্ষে কুয়েত

কিন্তু এই স্বস্তি কি টেকসই? নাকি বর্ষার ভারী বর্ষণের নিচে চাপা পড়ে আছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা? চলুন, আজকের এই সাময়িক স্বস্তির খবরের পাশাপাশি দূষণের বৃহত্তর চিত্রটা একটু বিশ্লেষণ করে দেখি।

আজকের চিত্র: ঢাকা নিচে, কুয়েত সিটি শীর্ষে

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, আজ সোমবার সকাল সোয়া আটটায় ঢাকার বায়ুমান ছিল মাত্র ৫৫। এই স্কোরটিকে ‘সহনীয়’ বা ‘মডারেট’ হিসেবে ধরা হয়। গতকালও ঢাকার বাতাস সহনীয় পর্যায়েই ছিল, স্কোর ছিল ৯০। মজার বিষয় হলো, বায়ুদূষণের তালিকায় যেখানে ঢাকা প্রায়শই শীর্ষ দশে থাকে, আজ তার অবস্থান ৫৮ নম্বরে। এক লাফে এতটা উন্নতি নিঃসন্দেহে চোখে পড়ার মতো। দূষণের শীর্ষে কুয়েত

তবে আমরা যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি, তখন বিশ্বের অন্য কোনো শহর হয়তো বিষাক্ত বাতাসে ধুঁকছে। আজকের তালিকার শীর্ষে রয়েছে কুয়েতের কুয়েত সিটি, যার বায়ুমান ১৭৯। এই মাত্রার বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে গণ্য করা হয়। শীর্ষ পাঁচে থাকা অন্য শহরগুলো হলো বাহরাইনের মানামা (১৬৫), কঙ্গোর কিনশাসা (১৫৩), পাকিস্তানের লাহোর (১৩৯) এবং জাপানের টোকিও (১১৭)। এই শহরগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, পরিবেশ দূষণ কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সংকট।

সহনীয় মানেই কি স্বাস্থ্যকর?

ঢাকার বাতাস আজ ‘সহনীয়’ পর্যায়ে থাকলেও আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একিউআই স্কোর ৫০-এর নিচে থাকলে তবেই তাকে বিশুদ্ধ বা স্বাস্থ্যকর বাতাস বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ স্কোরকে ‘সহনীয়’ বলা হলেও, সংবেদনশীল人群 যেমন—শিশু, বয়স্ক এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এই বাতাসও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। দূষণের শীর্ষে কুয়েত

আইকিউ-এয়ারের প্রতিবেদনে বারবার বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে দূষণের প্রধান উৎস হলো অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (PM2.5)। এই কণাগুলো এতটাই ছোট যে তা সরাসরি আমাদের রক্তে মিশে যেতে পারে এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদ্রোগ এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ৫২ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অভ্যন্তরীণ ও পারিপার্শ্বিক বায়ুদূষণের সম্মিলিত প্রভাবে বছরে ৬৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

এই পরিসংখ্যানগুলো মাথায় রাখলে, ঢাকার ‘সহনীয়’ বাতাস নিয়েও আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এই সাময়িক উন্নতি মূলত আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিপাতের কারণে। বর্ষা শেষ হলে হেমন্তের শুরু থেকেই দূষণের চেনা চেহারা আবার ফিরে আসবে।

বড় চিত্র: যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান উদ্বেগজনক

আজকের এক দিনের র‍্যাঙ্কিং দেখে উল্লসিত হওয়ার আগে আমাদের পেছনের দিকে তাকাতে হবে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ ছিল বাংলাদেশ ও চাদ। এটি কোনো একদিনের চিত্র নয়, এটি সারা বছরের গড়। এই তথ্যটিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ঢাকার পরিবেশ এবং সামগ্রিকভাবে দেশের বায়ুর মান কতটা গুরুতর সংকটের মধ্যে রয়েছে।

এই দীর্ঘমেয়াদী দূষণের কারণগুলো আমাদের সবারই জানা—অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নিয়ন্ত্রণহীন নির্মাণকাজ, মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, শিল্প-কারখানার দূষণ এবং ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া। এই প্রতিটি কারণই কেবল বায়ুদূষণ নয়, বরং বৃহত্তর জলবায়ু পরিবর্তন সংকটের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার একদিকে যেমন বাতাসকে বিষাক্ত করছে, তেমনি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে পৃথিবীর তাপমাত্রাও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

করণীয় কী? নির্দেশনা কি যথেষ্ট?

বায়ুদূষণ রোধে সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করেছে। যেমন: বাইরে বের হলে মাস্ক পরা, সংবেদনশীল ব্যক্তিদের অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়া, নির্মাণকাজ ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ট্রাক ঢেকে নেওয়া, রাস্তায় পানি ছিটানো এবং পুরোনো যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই নির্দেশনাগুলো কতটা পালিত হচ্ছে? রাস্তায় বেরোলেই আমরা এর উত্তর পেয়ে যাই। কঠিন বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ হয়নি, অনেক নির্মাণ প্রকল্পেই নিয়ম মানা হয় না, আর কালো ধোঁয়া ছড়ানো যানবাহন তো চলছেই। কার্যকর প্রয়োগ এবং কঠোর নজরদারির অভাবে এই ভালো উদ্যোগগুলোও অনেক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

শেষ কথা

ঢাকার আজকের সহনীয় বাতাসকে আমাদের একটি সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নির্মল বাতাস পাওয়ার অধিকার আমাদের আছে। বর্ষার প্রকৃতি যখন সাময়িকভাবে আমাদের শহরকে দূষণমুক্ত রাখছে, তখন আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে এই নির্মলতা ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।

এই সাময়িক স্বস্তি যেন আমাদের গাফিলতির কারণ না হয়। বরং এটি হওয়া উচিত একটি সতর্কবার্তা—টেকসই সমাধানের দিকে না এগোলে এই স্বস্তি ফুরিয়ে যেতে সময় লাগবে না। পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তি মেলা কঠিন।

আপনার মতামত কী?

আপনিও কি ঢাকার পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত? এই সংকট মোকাবেলায় আপনার ভাবনা বা ব্যক্তিগত উদ্যোগের কথা আমাদের জানান নিচের কমেন্ট বক্সে।

পরিবেশগত ঝুঁকি বিশ্লেষণ, টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কৌশল সম্পর্কে আরও জানতে বা আমাদের বিশেষজ্ঞ দলের সাথে কাজ করতে আগ্রহী হলে, আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন অথবা সরাসরি আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন, একসাথে একটি সবুজ ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ গড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ