আজকের আবহাওয়া বুলেটিনটা কি আপনার চোখে পড়েছে? “চার বিভাগে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সতর্কবার্তা।” খবরটা পড়তে পড়তে আমাদের অনেকেরই হয়তো গা সওয়া হয়ে গেছে। বর্ষাকালে এমন সতর্কবার্তা তো আসেই। কিন্তু আসুন, খবরের গভীরে ডুব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, এটা কি শুধুই একটি সাধারণ আবহাওয়া বার্তা, নাকি আমাদের দরজায় কড়া নাড়তে থাকা এক ভয়াবহ সংকটের পদধ্বনি? ভারী বৃষ্টি
ঘটনা হলো, আবহাওয়া অধিদপ্তর আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ভারী (২৪ ঘণ্টায় ৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (৮৮ মিলিমিটারের বেশি) বৃষ্টির যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, তা এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর ঠিক আগের দিনই ফেনীতে ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি বছরে ওই অঞ্চলের জন্য একটি রেকর্ড। এই সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, এগুলো আমাদের পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর করুণ অবস্থার এক জলজ্যান্ত রিপোর্ট কার্ড। ভারী বৃষ্টি
রেকর্ড বৃষ্টি ও ভূমিধসের আশঙ্কা: কীসের ইঙ্গিত?
যখন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্বল্প সময়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়, তখন দুটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। প্রথমত, আমাদের শহরগুলোর দুর্বল নিষ্কাশন ব্যবস্থা সেই বিপুল পরিমাণ পানি সরাতে পারে না। দ্বিতীয়ত, পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি সেই জলীয় চাপ সহ্য করতে না পেরে ধসে পড়ে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ঠিক এই দুটি বিষয়েই সতর্ক করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার মতো মহানগরীতে জলাবদ্ধতা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধসের আশঙ্কা। তুরাগ নদের পানি বেড়ে আশুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার দৃশ্যটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এই আশঙ্কা কতটা বাস্তব।
এই সংকটগুলোর জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? সাময়িকভাবে হয়তো সিটি কর্পোরেশনের নিষ্কাশন ব্যবস্থা বা পাহাড় কাটার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কথা বলব। কিন্তু মূল চালিকাশক্তি কে? কেন আমাদের পরিবেশ আজ এতটা ভঙ্গুর?
পরিবেশের ওপর আমাদের অবিচার: জলাবদ্ধতা ও ভূমিধসের মূল কারণ
আমাদের শহরগুলো, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম, এখন এক-একটি কংক্রিটের জঙ্গল। বৃষ্টির পানি শুষে নেওয়ার জন্য যে সবুজ মাটি, মাঠ বা জলাশয় দরকার, তার প্রায় সবকিছুই আমরা ভরাট করে ফেলেছি। খালগুলো দখল হয়ে নর্দমায় পরিণত হয়েছে, যা প্লাস্টিক আর আবর্জনায় প্রায় বন্ধ। ফলে, সামান্য বেশি বৃষ্টি হলেই এই শহরগুলোর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়। জলাবদ্ধতা এখন আর শুধু ভোগান্তি নয়, এটি আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণের অনিবার্য পরিণতি। ভারী বৃষ্টি
একইভাবে, চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়গুলোও আজ নিরাপদ নয়। অবৈধভাবে পাহাড় কাটা, গাছপালা উজাড় করে অপরিকল্পিত আবাসন তৈরির ফলে পাহাড়ের মাটির বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। তাই ভারী বৃষ্টি হলেই এই পাহাড়গুলো এক-একটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়। এই ভূমিধস প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও বেশি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়।
জলবায়ু পরিবর্তন: যে শত্রু পর্দার আড়ালে
এবার আসা যাক মূল কথায়। কেন এই বৃষ্টিপাতের ধরণ এমন খামখেয়ালি এবং তীব্র হয়ে উঠছে? এখানেই জলবায়ু পরিবর্তন-এর ভূমিকা।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বায়ুমণ্ডল এখন আগের চেয়ে বেশি জলীয় বাষ্প ধারণ করতে পারে। এর ফলে, যখন বৃষ্টি হয়, তখন তা স্বল্প সময়ে অনেক বেশি পরিমাণে ঝরে পড়ে। ফেনীর ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত এই “এক্সট্রিম রেইনফল ইভেন্ট” বা চরম বৃষ্টিপাতের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আগে যে বৃষ্টি হয়তো এক সপ্তাহ ধরে ঝিরঝিরে হতো, এখন সেই পরিমাণ পানি মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ঝরে পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে মৌসুমী বায়ু আরও বেশি সক্রিয় ও অনির্দেশ্য হয়ে উঠছে। এর ফলে আমরা দেখছি:
- বর্ষার আগমন ও প্রস্থানের সময়ের পরিবর্তন।
- স্বল্প সময়ে অতি ভারী বর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধি।
- শুকনো মৌসুমে দীর্ঘস্থায়ী খরা।
অর্থাৎ, আমাদের ঋতুচক্র তার স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। আজকের এই ভারী বর্ষণের সতর্কবার্তা সেই ভারসাম্যহীনতারই একটি লক্ষণ।
এক সূত্রে গাঁথা সংকট
বিষয়টি যদি আমরা এক সুতোয় বাঁধি, তাহলে দাঁড়ায়:
জলবায়ু পরিবর্তন -> বৃষ্টির তীব্রতা বৃদ্ধি -> দুর্বল নগর ও গ্রামীণ পরিবেশ-এর ওপর চরম আঘাত -> জলাবদ্ধতা ও ভূমিধসের মতো বিপর্যয় -> জনদুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক ক্ষতি।
এই চক্র ভাঙতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার। আমরা হয়তো সাময়িকভাবে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাব, কিংবা ভূমিধসের পর উদ্ধারকাজ চালাব, কিন্তু মূল কারণটি যদি উপেক্ষা করে যাই, তাহলে এই বিপর্যয়গুলো আরও ঘন ঘন এবং আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে ফিরে আসবে।
শেষ কথা
সুতরাং, আবহাওয়া অধিদপ্তরের এই সতর্কবার্তাটিকে শুধু একটি খবর হিসেবে দেখবেন না। এটি একটি জরুরি আহ্বান। এটি আমাদের বলছে, পরিবেশ নিয়ে আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। এটি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন কোনো দূর ভবিষ্যতের তাত্ত্বিক বিষয় নয়, এটি আমাদের বর্তমান এবং এর প্রভাব আমাদের জীবনকে সরাসরি আঘাত করছে। এই সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিবেশবান্ধব এবং জলবায়ু-সহনশীল পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতেই হবে।
আপনার মতামত কী?
আপনার এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কী কী প্রভাব আপনি লক্ষ্য করছেন? এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের করণীয় কী হতে পারে? আপনার ভাবনাগুলো কমেন্ট বক্সে জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ সংলাপে আমাদের সঙ্গী হোন।