27.2 C
Bangladesh
শনিবার, জুলাই ১২, ২০২৫
spot_img

সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ কেন পুড়ছে গরিবের চুলায়?

ভোরের আলোয় সুন্দরবন সংলগ্ন নদীর দিকে তাকালে মনে হয়, প্রকৃতি যেন এক ভাসমান সবুজের হাট বসিয়েছে। গরান, গেওয়া, সুন্দরী, পশুর—নাম না জানা হাজারো গাছের ফল স্রোতের সাথে ভেসে আসে, পাড়ে ভিড় করে। প্রতিটি ফলের ভেতর লুকিয়ে থাকে একটি নতুন গাছের জন্ম নেওয়ার স্বপ্ন, একটি নতুন অরণ্য তৈরির সম্ভাবনা। কিন্তু সেই স্বপ্ন তীরের মাটিতে পৌঁছানোর আগেই নিভে যায়। কারণ, নদীর পাড়ে ক্ষুধার্ত চুলার জ্বালানির জন্য অপেক্ষায় থাকেন গ্রামের মানুষ। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ

সম্প্রতি কয়রার শাকবাড়িয়া নদীর তীরে এই করুণ বাস্তবতার এক খণ্ডচিত্র দেখা যায়। নদীর পানিতে নেমে আরতি মণ্ডল, লক্ষ্মী রানীর মতো নারীরা ঝুড়ি ভর্তি করে কুড়িয়ে নিচ্ছেন সেই স্বপ্নবাহী ফলগুলো। এই ফলগুলো শুকিয়ে তাদের চুলার আগুন জ্বালাবে। লক্ষ্মী রানীর কথায় উঠে আসে কঠিন বাস্তবতা, “বাইনগাছের ফল তো আগুনে পোড়েই না, গরু-ছাগলের পেটে যায়।” অর্থাৎ, যে ফল জ্বালানি হয় না, তা হয়ে যায় পশুখাদ্য। কিন্তু কোনোভাবেই তা নতুন চারা হয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ

এই দৃশ্য শুধু এক দিনের বা এক গ্রামের নয়। এটি কয়রার উপকূলবর্তী বিশাল অঞ্চলের এক দৈনন্দিন চিত্র। এই সংবাদটি কেবল একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি আমাদের পরিবেশ সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর অভিঘাতের এক জটিল ও বেদনাদায়ক প্রতিচ্ছবি। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ

পেটের আগুন বনাম বনের আগুন: এক অসম লড়াই

এই ঘটনার গভীরে গেলে আমরা কোনো খলনায়ককে খুঁজে পাব না। পাব শুধু অসহায়ত্ব। কয়রার মঠবাড়ী গ্রামের হালিমা বেগমের কথায় এই দ্বন্দ্বটি স্পষ্ট: “চরে গাছ হইলে ভালোই হতো, নদী ভাঙত না; কিন্তু কয়ডা দিন কীভাবে চুলা বন্ধ রেখে থাকব কন?”

এই একটি বাক্যই পুরো সংকটকে তুলে ধরে। গ্রামের মানুষগুলো জানেন, এই ফলগুলোই একদিন গাছ হয়ে নদীর ভাঙন রোধ করবে, সবুজ বেষ্টনী তৈরি করবে, পাখিদের ফিরিয়ে আনবে। তারা পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব বোঝেন, কিন্তু তাদের সামনে প্রতিদিনের প্রশ্ন হলো—আজকের রান্নাটা হবে কী দিয়ে? যখন হাতের কাছে জ্বালানির অন্য কোনো সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী বিকল্প নেই, তখন সুন্দরবনের এই ভাসমান ফলই হয়ে ওঠে একমাত্র অবলম্বন।

এটি একটি ক্লাসিক “দারিদ্র্য-পরিবেশের দুষ্টচক্র” (Poverty-Environment Trap)।

দারিদ্র্য মানুষকে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল করে তোলে, আর প্রকৃতির এই অতিরিক্ত শোষণ পরিবেশকে আরও দুর্বল করে দেয়। দুর্বল পরিবেশ wiederum প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ায়, নদী ভাঙন ত্বরান্বিত করে, যা সেই মানুষগুলোকেই আরও দরিদ্র এবং অসহায় করে তোলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অদৃশ্য হাত

এই স্থানীয় সংকটের সাথে জলবায়ু পরিবর্তন-এর সংযোগ অত্যন্ত গভীর। সুন্দরবন কেবল একটি বন নয়, এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাকৃতিক বর্ম। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো জলবায়ু পরিবর্তন-এর ভয়াবহ প্রভাবগুলো থেকে এই বনটি আমাদের রক্ষা করে।

১. প্রাকৃতিক পুনর্জন্ম ব্যাহত: যে ফলগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো স্বাভাবিকভাবে চরে আটকালে নতুন ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করত। এই প্রাকৃতিক পুনর্জন্মই সুন্দরবনের টিকে থাকার মূল শক্তি। এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার অর্থ হলো, বন ভেতর থেকে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।

২. উপকূলীয় প্রতিরক্ষা দুর্বল হওয়া: নতুন বন তৈরি না হওয়ায় নদীর পাড়গুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে শক্তিশালী হওয়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সামনে এই দুর্বল উপকূল আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। অর্থাৎ, যে মানুষগুলো আজ জ্বালানির জন্য বনের বীজ পোড়াচ্ছেন, তারাই ভবিষ্যতে আরও ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হবেন।

৩. জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি: সুন্দরবনের এই ফলগুলো অসংখ্য পাখি, কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য। এই খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যাওয়ায় বনের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন-এর অভিঘাত মোকাবেলা করা প্রায় অসম্ভব।

কপোতাক্ষ কলেজের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধার হতাশা এখানেই, “দেখেন, এ ফলগুলো যদি নদীর চরে পড়ে থাকত, নতুন বন হতো। গরান-গেওয়ার সবুজ বেষ্টনী হলে নদীর পাড় ভাঙত না এতটা; কিন্তু সেই ফল চুলার আগুনেই শেষ।”

সমাধান কোথায়? সচেতনতা নাকি বিকল্প ব্যবস্থা?

সুন্দরবন ও উপকূল সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম কিংবা বন বিভাগের কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন—সবার কথাতেই সচেতনতার অভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পেটে ক্ষুধা নিয়ে সচেতনতার বুলি কতটা কার্যকর?

এই সমস্যার সমাধান শুধু মানুষকে “গাছ বাঁচান, পরিবেশ বাঁচান” বলে সচেতন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সমাধান লুকিয়ে আছে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের মধ্যে।

  1. বিকল্প জ্বালানির জোগান: যদি এই পরিবারগুলোকে সাশ্রয়ী মূল্যে এলপিজি গ্যাস, উন্নত চুলা (বন্ধু চুলা), বা বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের মতো বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, তবেই বনের ফলের ওপর এই নির্ভরশীলতা কমবে।
  2. বিকল্প জীবিকা: এই মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে তাদের শুধুমাত্র প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বাঁচতে না হয়।
  3. সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ: বন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একসাথে মিলে একটি টেকসই মডেল তৈরি করতে হবে, যেখানে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নও নিশ্চিত হয়।

শেষ কথা

সুন্দরবনের চুলায় পোড়া প্রতিটি ফল আসলে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতীক। এটি শুধু একটি জ্বালানি সংকট নয়, এটি একটি মানবিক এবং পরিবেশগত সংকট। আমরা যদি এই মানুষগুলোর চুলার আগুন নেভানোর জন্য টেকসই কোনো ব্যবস্থা না নিতে পারি, তবে একদিন সুন্দরবন নামক আমাদের এই সবুজ ঢালটিও হয়তো ভয়াবহ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তখন আর রক্ষা করার মতো কিছুই বাকি থাকবে না।

আপনার মতামত কী?

এই জটিল মানবিক ও পরিবেশগত সংকট সমাধানে আমাদের আর কী কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? আপনার ভাবনা কমেন্ট বক্সে জানান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ সংলাপে যোগ দিন। পরিবেশগত সচেতনতা বাড়াতে আমাদের সাথেই থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ