28 C
Bangladesh
শুক্রবার, জুলাই ১১, ২০২৫
spot_img

ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।

শিরোনামটি পড়েই হয়তো আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে। গাছ লাগানো যেখানে একটি মহৎ কাজ হিসেবে স্বীকৃত, সেখানে সরকারি উদ্যোগে লক্ষ লক্ষ গাছের চারা ধ্বংস করা হচ্ছে! সম্প্রতি নীলফামারীর ডোমারে ঠিক এমনটাই ঘটেছে। সেখানে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় দেড় লাখ আকাশমণি গাছের চারা ধ্বংস করা হয়েছে। শুধু আকাশমণি নয়, দেশজুড়ে ইউক্যালিপটাস গাছের চারাও এই নিধন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। আকাশমণির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

এই ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে विरोधाभासी মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে একটি গভীর পরিবেশ-গত বাস্তবতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার এক জরুরি কৌশল। চলুন, এই সংবাদের গভীরে প্রবেশ করে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক। আকাশমণির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

কেন এই নিধনযজ্ঞ?

ডোমার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি—এই দুই প্রজাতির গাছ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে মাটিকে রুক্ষ ও অনুর্বর করে তোলে। এর ফলে আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আকাশমণির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

মূলত, এই গাছগুলোকে বলা হয় “অ্যাগ্রেসিভ” বা আগ্রাসী প্রজাতি। এদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো:

  1. অতিরিক্ত পানি শোষণ: এরা দেশীয় গাছের তুলনায় বহুগুণ বেশি পানি মাটি থেকে টেনে নেয়। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যায়, যা খরাপ্রবণ অঞ্চলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তোলে।
  2. মাটির উর্বরতা হ্রাস: ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা ও ছালে থাকা বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ (অ্যালোপ্যাথিক প্রভাব) মাটিতে অন্য কোনো গাছ জন্মাতে বাধা দেয়। ফলে এর আশেপাশে প্রাকৃতিক ঘাস বা অন্যান্য উদ্ভিদের বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যায়।
  3. জীববৈচিত্র্য ধ্বংস: এই গাছগুলো আমাদের দেশীয় পাখি, কীটপতঙ্গ বা অন্যান্য প্রাণীর জন্য উপযুক্ত আশ্রয়স্থল বা খাদ্যের উৎস নয়। ফলে যে এলাকায় এই গাছগুলোর monoculture বা একক চাষ হয়, সেই এলাকা ধীরে ধীরে একটি “সবুজ মরুভূমি”-তে পরিণত হয়, যেখানে প্রাণের স্পন্দন কমে আসে।

এই কারণগুলো সামনে রেখেই সরকার এই গাছগুলোর চারা তৈরি, রোপণ এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। নীলফামারীর এই উদ্যোগ সেই সরকারি সিদ্ধান্তের একটি বাস্তব প্রতিফলন মাত্র।

এই গাছগুলো আমাদের প্রকৃতিতে এলো কীভাবে?

প্রশ্ন হলো, এত ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও এই গাছগুলো কীভাবে আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে কয়েক দশক পেছনে, সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের শুরুর দিকে।

আশির দশকে দ্রুত বর্ধনশীল এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় এই বিদেশি প্রজাতির গাছগুলোকে ব্যপকভাবে উৎসাহিত করা হয়েছিল। কম সময়ে কাঠ পাওয়া, জ্বালানির চাহিদা মেটানো এবং আসবাবপত্র তৈরির কাঁচামাল হিসেবে এর উপযোগিতা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক লাভের আড়ালে যে দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত বিপর্যয় লুকিয়ে ছিল, তা বুঝতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজকের এই চারা ধ্বংসের উদ্যোগটি আসলে সেই ঐতিহাসিক ভুলের একটি প্রায়শ্চিত্ত।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে এর সংযোগ কোথায়?

এখানেই বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি নিধনের এই পদক্ষেপটি সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার একটি অংশ। কীভাবে?

১. জলবায়ু সহনশীলতা (Climate Resilience) বৃদ্ধি:জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে আমাদের দেশ খরা এবং অনিয়মিত বৃষ্টির মতো চরম আবহাওয়ার শিকার হচ্ছে। ইউক্যালিপটাসের মতো গাছগুলো ভূগর্ভস্থ পানি শূন্য করে দিয়ে আমাদের খরা মোকাবেলার ক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে দেয়। এই গাছগুলো অপসারণ করে দেশীয় প্রজাতি রোপণ করলে তা মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং পানির সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করবে।

২. জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার: একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র জলবায়ু পরিবর্তন-এর অভিঘাত সহ্য করতে বেশি সক্ষম। দেশীয় গাছপালা স্থানীয় পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের আশ্রয় দিয়ে একটি শক্তিশালী প্রতিবেশ ব্যবস্থা তৈরি করে। এই জীববৈচিত্র্য পরাগায়ন, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে অপরিহার্য।

৩. টেকসই পরিবেশ: বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতি বাদ দিয়ে দেশীয় ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ (যেমন: আম, জাম, কাঁঠাল, নিম, হরিতকী, বহেড়া) লাগালে তা আমাদের পরিবেশ-কে টেকসই করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করবে। এটি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত করবে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পথ

অবশ্যই, এই রূপান্তর রাতারাতি সম্ভব নয়। নীলফামারীর নার্সারি মালিক মিজানুর রহমানের মতো হাজারো মানুষ আছেন, যারা এই গাছগুলোর চারা উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ এবং দেশীয় গাছের চারা উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য সরকারি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র চারা ধ্বংস করলেই হবে না, বিকল্প কর্মসংস্থানের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করতে হবে।

শেষ কথা

নীলফামারীর এই ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন সংবাদ নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় পরিবেশ নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এটি প্রমাণ করে যে আমরা স্বল্পমেয়াদী লাভের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত সুস্থতাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছি। এই উদ্যোগ সফল করতে হলে শুধু সরকারি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতা। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, কোন গাছ আমাদের বন্ধু এবং কোনটি বন্ধুর বেশে শত্রু। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ এবং বাসযোগ্য বাংলাদেশ রেখে যেতে হলে এই ধরনের কঠিন কিন্তু জরুরি সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতেই হবে।

আপনার মতামত কী?

আপনার এলাকায় কি ইউক্যালিপটাস বা আকাশমণি গাছের প্রভাব চোখে পড়ে? সরকারের এই উদ্যোগকে আপনি কীভাবে দেখছেন? আমাদের কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান এবং পরিবেশ রক্ষার এই সংলাপে অংশ নিন। আরও এমন বিশ্লেষণধর্মী পোস্ট পেতে আমাদের পেজটি ফলো করুন।

অবশ্যই! আপনার বিশ্লেষণধর্মী পোস্টটির জন্য নিচে আকর্ষনীয় শিরোনাম, মেটা ডেসক্রিপশন, ফেসবুক পোস্ট এবং একটি ভয়েস স্ক্রিপ্ট দেওয়া হলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ