27.8 C
Bangladesh
রবিবার, জুলাই ১৩, ২০২৫
spot_img

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ব্যর্থতা র আসল কারণ কী?

ঢাকার আকাশে-বাতাসে এখন শুধু বর্ষার মেঘ নয়, ডেঙ্গুর আতঙ্কও ভাসছে। হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, আর মৃত্যুর খাতাটাও দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিদিন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে, আর মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশতাধিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ব্যর্থতা

প্রতি বছর একই দৃশ্য। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কোটি কোটি টাকা খরচ করে, ফগিং মেশিনের ধোঁয়ায় শহর ঢেকে যায়, গণমাধ্যমে চলে ব্যাপক প্রচারণা। কিন্তু ফলাফল প্রায় শূন্য। প্রশ্ন হলো, এত আয়োজন, এত অর্থব্যয়ের পরও সামান্য এক মশার কাছে কেন বারবার হেরে যাচ্ছে দেশের রাজধানী?

এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের যুদ্ধ কৌশলের মধ্যেই। আমরা ভুল শত্রুর পেছনে ছুটছি।

আসল শত্রু ঘরে, যুদ্ধ চলছে ড্রেনে!

বিষয়টি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন দেশের শীর্ষ কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তাঁর মতে, সিটি কর্পোরেশন ‘মশা নিয়ন্ত্রণ’ এবং ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ’কে এক করে ফেলেছে, যা একটি মারাত্মক ভুল।

সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা যে ফগিং মেশিন দিয়ে নালা-নর্দমা বা আবর্জনার স্তূপে ওষুধ ছিটান, তা মূলত কিউলেক্স মশা নিধন করে। এই মশাগুলো বিরক্তিকর হলেও ডেঙ্গু ছড়ায় না। অন্যদিকে, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা হলো এক ধূর্ত ও ‘অভিজাত’ শত্রু। সে নোংরা ড্রেনের পানিতে নয়, বরং আমাদের বাড়ি, বারান্দা, ছাদ বা অফিসের ভেতরে জমে থাকা স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানিতে বংশবৃদ্ধি করে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ব্যর্থতা

অর্থাৎ, যে ধোঁয়া আমরা রাস্তায় দেখছি, তা ডেঙ্গুর আসল বাহক এডিস মশাকে স্পর্শই করতে পারছে না। সে আমাদের ঘরে, ফুলের টবে, পরিত্যক্ত টায়ারে বা নির্মাণাধীন ভবনের চৌবাচ্চায় নিরাপদেই বেড়ে উঠছে।

পরিবেশের অবহেলা ও জলবায়ুর পরিবর্তনে মশার পোয়াবারো

এডিস মশার এই নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরির জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিবেশগত অসচেতনতা ডেঙ্গুর জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার ১৩টি ওয়ার্ড এখন ডেঙ্গুর জন্য ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’। এই এলাকাগুলোতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে বিপজ্জনক মাত্রায়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ব্যর্থতা

এর সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রভাব, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

  1. বাড়তি তাপমাত্রা: উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে এডিস মশার জীবনচক্রের সময় কমে আসছে। ফলে তারা আগের চেয়ে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করছে।
  2. অনিয়মিত বৃষ্টিপাত: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে গেছে। হুট করে তীব্র বৃষ্টি হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকছে, যা এডিস মশার প্রজননক্ষেত্রকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এক কথায়, আমাদের পরিবেশগত অব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মিলিত প্রভাবে ডেঙ্গু এখন আর শুধু বর্ষাকালের রোগ নেই, এটি প্রায় সারাবছরের মহামারিতে রূপ নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: সমাধান কোথায়?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চক্র থেকে বের হতে হলে গতানুগতিক পথ থেকে সরে আসতে হবে। সমাধানের জন্য চারটি দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি:

  1. চিরুনি অভিযান: ড্রেনে ফগিং করার বদলে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে এডিসের সম্ভাব্য প্রজননস্থল খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে হবে।
  2. কঠোর আইন প্রয়োগ: কোনো বাড়িতে বারবার এডিসের লার্ভা পাওয়া গেলে সতর্ক করার পর প্রয়োজনে জরিমানা করতে হবে।
  3. নাগরিক সচেতনতা: প্রতিটি নাগরিককে ‘আমার বাড়ি, আমার দায়িত্ব’—এই নীতিতে বিশ্বাসী হতে হবে। নিজের ঘর ও আশপাশ পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।
  4. বছরব্যাপী মনিটরিং: শুধু বর্ষার সময় নয়, সারা বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি বিশেষায়িত দল গঠন করতে হবে, যারা শুধুমাত্র এডিস মশা নিয়েই কাজ করবে।

শেষ কথা

ডেঙ্গু এখন আর নিছক একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়। এটি আমাদের পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ পরিণামের একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। এখনই যদি আমরা আমাদের কৌশল পরিবর্তন না করি এবং সঠিক শত্রুকে চিহ্নিত করে সমন্বিত ব্যবস্থা না নিই, তবে প্রতি বছর এই মৃত্যুর মিছিল দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

আপনার মতামত কী?

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা কতটুকু? এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী? আপনার মূল্যবান মতামত নিচের কমেন্ট বক্সে জানান।

পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত এমন আরও বিশ্লেষণমূলক লেখা পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ