“মাছে ভাতে বাঙালি“—এই কথাটা শুনলেই আমাদের সবার মনে একটা তৃপ্তির ছবি ভেসে ওঠে। গরম ভাতের সাথে এক টুকরো ইলিশ ভাজা, কিংবা কৈ মাছের ঝোল! কিন্তু একবার ভেবে দেখেছেন, এই তৃপ্তির উৎস যদি দিন দিন শুকিয়ে যায়? যদি আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল থেকে মাছই উধাও হয়ে যায়? জেলেরাই এখন মা মাছের রক্ষক
এটা কোনো কাল্পনিক দুঃস্বপ্ন নয়, বরং এক কঠিন বাস্তবতা। নির্বিচারে মাছ শিকার, বিশেষ করে ডিমওয়ালা ‘মা’ মাছ ধরে ফেলার কারণে আমাদের বহু জলাশয় আজ মাছশূন্য হওয়ার পথে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বরগুনার বেতাগী উপজেলার ঝোপখালী খালের একটি ছোট্ট উদ্যোগ বিশাল আশার আলো দেখাচ্ছে। এটি শুধু একটি খালের মাছ বাঁচানোর গল্প নয়, এটি আমাদের পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জেলেরাই এখন মা মাছের রক্ষক
ঝোপখালী খালের ‘বিশেষ প্রকল্প’: ব্যাপারটা কী?
বরগুনার বেতাগী উপজেলার ঝোপখালী খালকে এখন ‘মা মাছের নিরাপদ অভয়াশ্রম’ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় মৎস্য বিভাগ এই বিশেষ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো ইলিশসহ অন্যান্য দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রকে সুরক্ষিত করা। জেলেরাই এখন মা মাছের রক্ষক
একসময় এই এলাকার বেড়েরধন নদী প্রচুর ইলিশ ও দেশীয় মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অবৈধ জালের ব্যবহার এবং নির্বিচারে মা মাছ ধরার ফলে সেই সোনালী দিন হারিয়ে যেতে বসেছিল। বেতাগী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. তুরাণ যেমনটা বলছিলেন, মা মাছের সংখ্যা এতটাই কমে গিয়েছিল যে পুরো মৎস্য খাতই হুমকির মুখে পড়ে।
এখন এই প্রকল্পের আওতায় যা যা করা হচ্ছে:
- নিরাপদ অভয়াশ্রম ঘোষণা: খালটিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মাছ ধরার আওতামুক্ত রাখা হচ্ছে, যাতে মা মাছেরা নির্ভয়ে ডিম ছাড়তে পারে।
- অবৈধ জাল উচ্ছেদ: কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জালের মতো ধ্বংসাত্মক সব জাল ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানো হচ্ছে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: মাইকিং, লিফলেট ও ব্যানারের মাধ্যমে স্থানীয় জেলে এবং সাধারণ মানুষকে মা মাছ রক্ষার গুরুত্ব বোঝানো হচ্ছে।
এই উদ্যোগটি বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ মনে হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একটি মা মাছকে রক্ষা করার অর্থ হলো হাজার হাজার,甚至 লাখ লাখ পোনা মাছের জন্ম নিশ্চিত করা। এটি প্রকৃতির নিজস্ব উপায়ে সম্পদ বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
শুধু মাছ নয়, মানুষেরও সুরক্ষা
যেকোনো পরিবেশ-বান্ধব প্রকল্প তখনই সফল হয়, যখন এর সাথে স্থানীয় মানুষকে যুক্ত করা যায়। এই প্রকল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো, এটি জেলেদের শত্রু না ভেবে বন্ধু হিসেবে পাশে নিয়েছে।
সাধারণত জেলেরা অভাবে পড়েই নিষিদ্ধ সময়ে বা নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরেন। তাঁদের রুটি-রুজির কথা না ভেবে শুধু নিষেধাজ্ঞা জারি করলে সেই আইন কাগজে-কলমেই থেকে যায়। ঝোপখালী প্রকল্পের উদ্যোক্তারা এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন। তাই তাঁরা জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এতে জেলেরা একদিকে যেমন আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকছেন, তেমনই অন্যদিকে নিজেরাই হয়ে উঠছেন এই অভয়াশ্রমের পাহারাদার।
বেতাগী সদর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান তালুকদারের মতে, এই প্রকল্প শুধু মাছের উৎপাদন বাড়াবে না, বরং এলাকার সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। কারণ যখন খালে মাছ বাড়বে, তখন বৈধ উপায়ে মাছ ধরে জেলেরা আরও বেশি লাভবান হবেন। এটি একটি স্বনির্ভর এবং টেকসই মডেল।
ছোট্ট খালের বড় শিক্ষা: পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা
এখন প্রশ্ন হলো, একটি ছোট খালের প্রকল্প কীভাবে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন-এর মতো বিশাল বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত?
এর উত্তর হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো—যেমন, নদীর নাব্যতা হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, এবং পানির তাপমাত্রা পরিবর্তন—আমাদের মৎস্য সম্পদের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। এই প্রতিকূল পরিবেশে মাছের টিকে থাকা এবং বংশবৃদ্ধি করা এমনিতেই কঠিন হয়ে পড়েছে। তার উপর যদি আমরা নির্বিচারে মা মাছ নিধন করতে থাকি, তাহলে এই সংকট আরও গভীর হবে।
ঝোপখালীর এই প্রকল্পটি আমাদের শেখাচ্ছে যে, বড় বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়েও লড়াইটা জরুরি। স্থানীয়ভাবে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে পারলে তা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা বাড়ায়। একটি সুস্থ জলজ বাস্তুতন্ত্র কেবল মাছের জোগান দেয় না, এটি পানির গুণমান ভালো রাখে এবং সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
এই মডেলটি প্রমাণ করে যে, পরিবেশ সুরক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার অন্যতম শর্ত। ঝোপখালীর এই উদ্যোগ যদি সফল হয়, তবে এটি সারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জন্যও একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।
শেষ কথা
ঝোপখালী খালের এই উদ্যোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। মা মাছকে বাঁচানো মানে শুধু আমাদের মাছের থালাকে সুরক্ষিত করা নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ পরিবেশ উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার। ছোট ছোট এমন অসংখ্য উদ্যোগের মাধ্যমেই আমরা একটি সবুজ এবং টেকসই বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আপনার প্রতিষ্ঠান কি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চায়? টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা বা কমিউনিটিভিত্তিক পরিবেশ প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও কৌশলগত সহায়তার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন, একসাথে একটি সবুজ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কাজ করি।