বন্যার পানি যখন ধীরে ধীরে সরে যায়, তখন রেখে যায় এক ভয়াবহ ধ্বংসের চিত্র। রাস্তাঘাট ভাঙা, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, ফসলের মাঠ পচা কাদার নিচে ঢাকা। ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার মানুষ এখন ঠিক এই বাস্তবতার মুখোমুখি। পানি হয়তো আর কয়েক দিনে পুরোপুরি নেমে যাবে, কিন্তু যে ক্ষত তৈরি হলো, তা কি কেবল ত্রাণ বা तात्ক্ষণিক মেরামত দিয়ে পূরণ করা সম্ভব? ফেনীর ক্ষত শুকাবে কবে
ফেনীর এই বন্যাকে যদি আমরা শুধু একটি মৌসুমী দুর্যোগ বা ‘পাহাড়ি ঢল’ বলে চালিয়ে দিই, তবে আমরা সবচেয়ে বড় ভুলটা করব। এটি একটি অশনি সংকেত। এটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর পাঠ্যবইয়ের বিষয় নয়, এটি আমাদের ঘরের দুয়ারে দাঁড়ানো এক নির্মম বাস্তবতা। ফেনীর ক্ষত শুকাবে কবে
ক্ষত যখন ভেসে ওঠে
গত ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া টানা বৃষ্টি এবং ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ৩৬টি স্থানে ভেঙে যায়। এর ফলে জেলার পাঁচটি উপজেলাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে ফুলগাজী ও পরশুরামের অবস্থা সবচেয়ে গুরুতর।
পানি নামার সাথে সাথে যে চিত্রগুলো সামনে আসছে, তা শিউরে ওঠার মতো:
- কৃষি ও মৎস্য খাতে বিপর্যয়: জেলার প্রায় ২,৩৩০টি পুকুর, হ্যাচারি ও খামার ডুবে গেছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তার প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, শুধু মৎস্য খাতেই ক্ষতির পরিমাণ ৮ কোটি টাকার বেশি।
- প্রাণিসম্পদের ক্ষতি: হাঁস, মুরগি, ছাগলসহ হাজার হাজার গবাদিপশু মারা গেছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা। আমনের বীজতলা এবং সবজি খেত নষ্ট হওয়ায় কৃষকদের মাথায় হাত।
- ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা: ফুলগাজীর মুন্সিরহাট থেকে কামাল্লা যাওয়ার সড়কের মতো বহু গ্রামীণ রাস্তা ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষের অপেক্ষায় না থেকে স্থানীয় মানুষজনই চাঁদা তুলে, স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা মেরামত করার চেষ্টা করছেন। স্বেচ্ছাসেবক আবুল কালামের মতো মানুষেরা যখন বলেন, “এলাকার লোকজনের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহ করে সড়ক মেরামত করছি,” তখন তা একদিকে যেমন মানুষের সহনশীলতার পরিচয় দেয়, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফেনীর ক্ষত শুকাবে কবে
“আমার বাড়িতে আগে কখনো পানি উঠত না”
এই বন্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণটি হয়তো কোনো বিশেষজ্ঞ বা কর্মকর্তার কাছ থেকে আসেনি, এসেছে আনন্দপুর ইউনিয়নের কালীরহাট এলাকার বৃদ্ধ আবদুল করিমের কাছ থেকে। তিনি বলেন, “অতীতে এত বৃষ্টি বা বন্যা হলেও তাঁর বাড়িতে কখনো পানি উঠত না।”
তাঁর এই একটি কথাই পুরো পরিস্থিতিকে স্পষ্ট করে দেয়। এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি একটি পরিবর্তিত বাস্তবতার চিত্র। যে বৃষ্টি বা বন্যা আগে সহনীয় ছিল, এখন তা কেন সর্বনাশা রূপ নিচ্ছে? এর কারণ হলো, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন-এর ফলে আবহাওয়ার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাত হচ্ছে আরও তীব্র, স্বল্প সময়ে অনেক বেশি। পাহাড়ি ঢলের শক্তিও আগের চেয়ে অনেক বেশি। আমাদের পুরোনো বেড়িবাঁধ বা অবকাঠামো এই নতুন বাস্তবতার চাপ নিতে পারছে না। তাই মুহুরী নদীর বাঁধের ৩৬টি ভাঙন কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের প্রস্তুতির অভাব এবং প্রকৃতির পরিবর্তিত আচরণের ফল।
এদিকে, পানিবন্দী মানুষেরা যখন অভিযোগ করেন যে, “কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে খোঁজখবর নিতে দেখা যায়নি,” তখন তা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়হীনতাকেও সামনে নিয়ে আসে।
প্রতিক্রিয়াশীল বনাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
এখন কী হচ্ছে? পানি নামছে। প্রশাসন ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করছে। ত্রাণ বিতরণ চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, পানি নেমে গেলে বাঁধ মেরামত করা হবে। এই সবকিছুই হলো প্রতিক্রিয়াশীল (Reactive) ব্যবস্থা। অর্থাৎ, ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা।
কিন্তু আমাদের এখন যা দরকার, তা হলো প্রতিরোধমূলক (Proactive) ব্যবস্থা। আমাদের ভাবতে হবে:
- কেন বারবার একই জায়গায় বাঁধ ভাঙে? বাঁধগুলোর নকশা কি বর্তমান জলবায়ুর জন্য উপযুক্ত?
- নদীগুলোর নাব্যতা কি কমে গেছে? পলি জমে নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়াও বন্যার একটি বড় কারণ।
- আমরা কি শুধু বাঁধ মেরামতের চক্রেই আটকে থাকব, নাকি জলবায়ু-সহনশীল, দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের দিকে যাব?
ফেনীর এই বন্যা একটি ক্ষুদ্র চিত্র মাত্র। এটি আমাদের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো পরিকল্পনা এবং পরিবেশ নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। শুধু ত্রাণ বিতরণ আর ভাঙা বাঁধ মেরামত করে এই চক্র থেকে বের হওয়া যাবে না।
শেষ কথা
ফুলগাজীর পানিবন্দী মানুষ বা পরশুরামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের হাহাকার কেবল তাদের একার নয়। এটি পুরো বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আজকের ফেনীর চিত্র কাল দেশের অন্য যেকোনো প্রান্তে দেখা যেতে পারে। তাই এই ক্ষয়ক্ষতিকে শুধু টাকার অংকে পরিমাপ না করে, একে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের ব্যর্থতার সূচক হিসেবে দেখতে হবে। সমাধানের পথ খুঁজতে হবে তৃণমূল থেকে, স্থানীয় জ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তিকে একীভূত করে। নতুবা, প্রতি বছর পানি নামবে, আর রেখে যাবে এমন ক্ষত, যা শুকানোর আগেই নতুন করে প্লাবিত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই কঠিন বাস্তবতায় আপনার প্রতিষ্ঠান কি একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত? দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ এবং টেকসই পুনর্বাসন প্রকল্পে কৌশলগত পরামর্শ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য আমাদের বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন, प्रतिक्रिया নয়, প্রতিরোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলি।