১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই কোমরপানি। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, কয়েক ডজন সভা, আর অগণিত প্রতিশ্রুতির পরেও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম আবারও ডুবল। এই দৃশ্য এখন আর নতুন নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচের পরেও কেন এই শহরের ভাগ্য ফিরছে না? চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা
কর্তৃপক্ষ হয়তো প্রকৃতির ওপর দায় চাপিয়ে বলবেন, “বৃষ্টির তীব্রতা বেশি ছিল“। কিন্তু আসলেই কি তাই? নাকি এই জলাবদ্ধতার পেছনে লুকিয়ে আছে অব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর এক ভয়ঙ্কর ত্রিভুজ, যা চট্টগ্রামকে ধীরে ধীরে এক অকার্যকর নগরীতে পরিণত করছে? এই পোস্টে আমরা শুধু ডুবন্ত সড়কের ছবি দেখব না, বরং এই সংকটের গভীরে ডুব দেব। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা
প্রকল্পের মহাসাগর, কিন্তু সুফল এক ফোঁটাও কি?
বিগত আট বছরে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি বড় প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় ৯,৮৫২ কোটি টাকা। এই টাকায় নতুন খাল খনন, জলকপাট নির্মাণ, এবং নালা-নর্দমা সংস্কারের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে বছরের পর বছর, অথচ এখনও অনেক জলকপাট চালু হয়নি, খালের খননকাজ শেষ হয়নি, এবং পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি মৌসুমের শুরুতে খাল ও নালাগুলো পরিষ্কার থাকায় ১৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতেও শহর এতটা ডোবেনি। কিন্তু মাত্র কদিন পরেই ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে এই অবস্থা প্রমাণ করে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব কতটা প্রকট। খাল পরিষ্কার করা হয়, কিন্তু মানুষ আবার ময়লা ফেলে তা ভরাট করে। এটি একটি দুষ্টচক্র। এই হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ তাই এক অন্তহীন গর্তে টাকা ফেলার মতোই মনে হচ্ছে, যার কোনো দৃশ্যমান সুফল নগরবাসী পাচ্ছে না। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা
পাহাড় কাটা: শহরের ফুসফুস কেটে নালায় ফেলা
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার একটি অন্যতম প্রধান এবং আলোচিত কারণ হলো নির্বিচারে পাহাড় কাটা। বারবার সিদ্ধান্ত হওয়া সত্ত্বেও এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ হয়নি। এর প্রভাব অত্যন্ত সরাসরি এবং বিধ্বংসী।
বিষয়টা সহজভাবে ভাবুন:
১. যখন পাহাড় কাটা হয়, তখন মাটি আলগা হয়ে যায়।
২. বৃষ্টির পানিতে সেই মাটি ও বালি ধুয়ে সরাসরি শহরের নালা এবং খালগুলোতে গিয়ে জমা হয়।
৩. ফলে খালের গভীরতা কমে যায়, পানি ধারণক্ষমতা নষ্ট হয় এবং পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়।
৪. ফলাফল? সামান্য বৃষ্টিতেই পানি আর নামতে পারে না, সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
এটি কেবল একটি জলাবদ্ধতার সমস্যা নয়, এটি একটি মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়। আমরা একদিকে খাল খনন করে পানি যাওয়ার পথ তৈরি করছি, অন্যদিকে পাহাড় কেটে সেই পথ মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছি। এটি একটি আত্মঘাতী প্রক্রিয়া, যা প্রমাণ করে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা কতটা অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন।
জলবায়ু পরিবর্তন: নীরব ঘাতকের পদধ্বনি
এবার আসা যাক মূল কথায়। স্থানীয় অব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ ধ্বংসের সাথে যখন জলবায়ু পরিবর্তন যুক্ত হয়, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা এবং নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টিপাত বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মানে শুধু গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি নয়। এর মানে হলো আবহাওয়ার চরম ভাবাপন্নতা (Extreme Weather Events)। অর্থাৎ, যখন বৃষ্টি হবে, তখন অল্প সময়ে অতি ভারী বর্ষণ হবে। চট্টগ্রামের ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টি সেই চরম আবহাওয়ারই একটি উদাহরণ।
আমাদের শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা হয়তো স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত সামাল দেওয়ার জন্য তৈরি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে যে আকস্মিক ও তীব্র বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তা ধারণ করার ক্ষমতা এই দুর্বল এবং অপরিকল্পিত ব্যবস্থার নেই। সুতরাং, প্রকৃতির ওপর দায় চাপানোটা আসলে মূল সত্যকে আড়াল করার একটি সহজ উপায় মাত্র। আসল সত্য হলো, আমাদের শহরগুলো জলবায়ু পরিবর্তন-এর অভিঘাত মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত নয়।
শেষ কথা: ডুবছে চট্টগ্রাম, নাকি আমাদের বিবেক?
হাঁটু থেকে কোমরপানি ভেঙে স্কুলে যাওয়া শিশু, দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া দিয়ে অফিসে যাওয়া সাধারণ মানুষ, আর দোকানের মালামাল বাঁচাতে ব্যস্ত ব্যবসায়ীর আর্তনাদ—এগুলো শুধু জলাবদ্ধতার ছবি নয়। এগুলো আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
৩৪টি সভা, ২০০ সিদ্ধান্ত, আর হাজার কোটি টাকার প্রকল্প—এসব পরিসংখ্যান অর্থহীন হয়ে যায় যখন একটি মাঝারি বৃষ্টিতেই শহর ডুবে যায়। সমাধান শুধু নতুন প্রকল্পে বা আরও বেশি টাকা বরাদ্দের মধ্যে নেই। সমাধান লুকিয়ে আছে একটি সমন্বিত এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনায়।
পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কঠোর করতে হবে। প্রকল্পগুলোর কাজ সময়মতো শেষ করে তার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভবিষ্যতের অবকাঠামো নির্মাণের সময় জলবায়ু পরিবর্তন-এর আসন্ন বিপদকে মাথায় রাখতে হবে।
নতুবা, আমরা যতই টাকা ঢালি না কেন, চট্টগ্রাম শুধু বৃষ্টির পানিতে ডুববে না; ডুববে আমাদের অপরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা আর পরিবেশের প্রতি চরম উদাসীনতার অতল গহ্বরে।
আপনার ভাবনা কী?
এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চট্টগ্রামের জন্য কোন পদক্ষেপটি সবচেয়ে জরুরি বলে আপনি মনে করেন? আপনার মতামত কমেন্টে জানান।
টেকসই নগর পরিকল্পনা এবং জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষজ্ঞ পরামর্শের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন, একসাথে একটি বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ গড়ি।