বিশ্ব বাঘ দিবসে আমরা যখন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১টি বেড়ে ১২৫-এ পৌঁছানোর খবরে আনন্দিত হই, তখন একটি ভয়ঙ্কর সত্য আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। গত আড়াই দশকে সুন্দরবনের ২১টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও, ২৬টি বাঘকে প্রাণ দিতে হয়েছে পাচারকারীদের হাতে। এই পরিসংখ্যান একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়: বাঘের জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এখন আর প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ নয়, বরং মানুষ। বাঘ হত্যাকারীরা
কিন্তু এই দৃশ্যমান শত্রুর আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও এক নীরব ঘাতক—যা ধীরে ধীরে সুন্দরবনের বুক থেকে বাঘের অস্তিত্বকে মুছে ফেলার আয়োজন করছে। এই পোস্টে আমরা বিশ্লেষণ করব, বাঘের জন্য পাচারকারীর বুলেট কতটা মারাত্মক, এবং তার চেয়েও ভয়ঙ্কর শত্রু হিসেবে কীভাবে আবির্ভূত হচ্ছে আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন। বাঘ হত্যাকারীরা
প্রথম শত্রু: পাচারকারী এবং দুর্বল আইন
তথ্য অনুযায়ী, বাঘের চামড়া ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চক্র সক্রিয়, যার জাল বিশ্বের ১৫টি দেশে বিস্তৃত। সুন্দরবনে বাঘ হত্যা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদ্ধারের ঘটনায় গত দেড় দশকে ১৯টি মামলা হলেও, তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি এখনো বিচারাধীন। যে ১০টি মামলার রায় হয়েছে, তার মধ্যে ছয়টিতেই আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে রয়েছে আইনি প্রক্রিয়ার নানা দুর্বলতা। মামলার এজাহার তৈরিতে ত্রুটি, একাধিক আসামির জবানবন্দি হুবহু এক হওয়া এবং সাক্ষীদের আদালতে জোরালোভাবে সাক্ষ্য দিতে না পারার মতো সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা খুব সহজেই জামিনে বেরিয়ে আসে। বন বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, জামিনে মুক্ত হয়ে এরা আবারও একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বাঘ হত্যাকারীরা
এই দুর্বল বিচার ব্যবস্থা পাচারকারীদের জন্য একটি সবুজ সংকেত। যখন একটি বাঘ হত্যার শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না, তখন চোরাশিকারিরা আরও নির্ভয় হয়ে ওঠে। এটি একটি দুষ্টচক্র, যা বাঘের অস্তিত্বকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলছে।
দ্বিতীয় শত্রু: হরিণ শিকার এবং খাদ্যের সংকট
বাঘের অস্তিত্বের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তার শিকার বা খাবার। দেশের শীর্ষস্থানীয় বাঘ গবেষকদের মতে, বাঘের খাদ্যের প্রায় ৭৮ শতাংশই আসে হরিণ থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে হরিণ শিকারের তৎপরতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। শুধু জুন মাসেই ১৪২টি হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করা হয়েছে, যা সংকটের গভীরতা তুলে ধরে।
যখন বন থেকে হরিণ কমে যায়, তখন বাঘের জন্য খাদ্যসংকট তৈরি হয়। খাবারের সন্ধানে বাঘ তখন লোকালয়ের দিকে আসতে বাধ্য হয় এবং মানুষ-বাঘ সংঘাত বাড়ে। গত আড়াই দশকে গ্রামবাসীর হাতে ১৪টি বাঘের মৃত্যুর পেছনে এই খাদ্যসংকট একটি বড় কারণ। বন বিভাগ এখন নৌকার পাশাপাশি হেঁটে টহল দেওয়ার মতো নতুন কৌশল নিলেও, চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্য পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। হরিণের এই ব্যাপক নিধন আসলে বাঘকে ধীরে ধীরে অনাহারের দিকে ঠেলে দেওয়ারই নামান্তর।
আসল ঘাতক: জলবায়ু পরিবর্তন এবং লবণাক্ততার আগ্রাসন
পাচারকারী বা হরিণ শিকারিরা হলো দৃশ্যমান শত্রু, যাদের হয়তো আইনের আওতায় আনা সম্ভব। কিন্তু বাঘের জন্য সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘমেয়াদী বিপদটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এই শত্রু অদৃশ্য, কিন্তু এর প্রভাব অত্যন্ত বিধ্বংসী।
বাস্তবতা হলো:
১. লবণাক্ততা বৃদ্ধি:জলবায়ু পরিবর্তন এবং উজানে নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি এখন সুন্দরবনের অনেক গভীরে প্রবেশ করছে। এর ফলে সুন্দরী গাছের মতো মিষ্টি পানি-নির্ভর গাছপালা মরে যাচ্ছে।
২. বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয়: গাছের বৈচিত্র্য কমে যাওয়ায় বনের সামগ্রিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতা নষ্ট হচ্ছে।
৩. খাদ্যশৃঙ্খলে আঘাত: যে গাছপালা কমে যাচ্ছে, সেগুলোই হরিণের প্রধান খাদ্য। ফলে হরিণের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসছে, যা সরাসরি বাঘের খাদ্যসংকট তৈরি করছে।
অর্থাৎ, আমরা যদি পাচার শতভাগ বন্ধও করতে পারি, তারপরও বাঘকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ তার বেঁচে থাকার জন্য যে সুস্থ পরিবেশ দরকার, সেই বনটিই ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সুন্দরবনের আশেপাশে শিল্পায়নের বিস্তার এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। বাঘ হলো খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে থাকা প্রাণী। তার ভিত্তি যদি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে সে নিজে থেকেই বিলুপ্তির পথে হাঁটবে।
শেষ কথা: লড়াইটা দ্বিমুখী
“বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের প্রবৃদ্ধি”—এ বছরের প্রতিপাদ্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এটি মনে করিয়ে দেয় যে, বাঘের ভালো থাকা মানেই সুন্দরবনের ভালো থাকা। কিন্তু এই ভালো থাকা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের একটি দ্বিমুখী লড়াই লড়তে হবে।
একদিকে, বাঘ ও হরিণ শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে, আইনি দুর্বলতাগুলো দূর করে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং লবণাক্ততার মতো নীরব ঘাতকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ানো এবং এর চারপাশের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা এখন সময়ের দাবি।
কারণ একটি বাঘকে বুলেট দিয়ে একবারই মারা যায়। কিন্তু তার আবাসস্থল এবং খাদ্য কেড়ে নিলে তাকে এবং তার পুরো প্রজাতিকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
আপনার ভাবনা কী?
এই দ্বিমুখী সংকট মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিতভাবে কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? আপনার মতামত আমাদের জানান।
সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি নিরসনে টেকসই সমাধানের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।