27 C
Bangladesh
রবিবার, আগস্ট ৩, ২০২৫
spot_img

আমাদের গ্যাসলাইনগুলো কি টাইম বোমা?

বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার গ্যাস হাওয়া! শিরোনামটি দেখে চমকে যাওয়াই স্বাভাবিক। পেট্রোবাংলার সাম্প্রতিক সেমিনারের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের গ্যাসলাইনগুলো যেন এক ফুটো বালতি, যা দিয়ে প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ছে দেশের মহামূল্যবান সম্পদ। কারিগরি ক্ষতি বা ‘সিস্টেম লস’-এর নামে এই যে বিপুল অপচয়, তা কেবল আমাদের অর্থনীতির জন্যই অশনিসংকেত নয়, এটি আমাদের পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লড়াইয়ে একটি নীরব ঘাতক। গ্যাসলাইনগুলো কি টাইম বোমা

এই পোস্টে আমরা শুধু আর্থিক ক্ষতির হিসাব কষব না, বরং গভীরে গিয়ে দেখব কীভাবে এই গ্যাসের অপচয় আমাদের পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে এবং কেন এটি বন্ধ করা জাতীয় নিরাপত্তার মতোই জরুরি।

ফুটো পাইপলাইন: শুধু টাকার অপচয় নয়

পেট্রোবাংলার তথ্যমতেই, পুরোনো ও জরাজীর্ণ পাইপলাইন, লাইনের লিকেজ এবং অবৈধ সংযোগের কারণে গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ গ্যাস অপচয় হয়েছে। বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেনের মতে, সঞ্চালন ও বিতরণ মিলিয়ে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গ্যাসলাইনগুলো কি টাইম বোমা

বিষয়টাকে সহজভাবে ভাবুন। সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে এবং বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে আমাদের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছে। অথচ সেই গ্যাসের একটি বড় অংশ গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই বাতাসে মিশে যাচ্ছে। একদিকে নতুন শিল্প সংযোগের জন্য গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে মূল্যবান গ্যাস নষ্ট হচ্ছে। এটি কেবল একটি অব্যবস্থাপনার চিত্রই নয়, এটি একটি জাতীয় অপচয়ের মহোৎসব।

আসল বিপদ পর্দার আড়ালে: মিথেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন

এখন আসা যাক মূল কথায়। যে গ্যাস অপচয় হচ্ছে, তা আসলে কী? প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল উপাদান হলো মিথেন (Methane, CH4)। পরিবেশ বিজ্ঞানের চোখে মিথেন একটি ভয়ঙ্কর গ্রিনহাউস গ্যাস। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য এটি কার্বন ডাই-অক্সাইডের (CO2) চেয়েও বহুগুণ বেশি দায়ী। স্বল্প সময়ে, যেমন ২০ বছরের হিসাবে, মিথেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে প্রায় ৮০ গুণ বেশি তাপ শোষণ করতে পারে।

তার মানে, আমাদের পাইপলাইন থেকে যে গ্যাস লিক হচ্ছে, তা কেবল গ্যাস নয়; এটি সরাসরি মিথেন গ্যাস, যা আমাদের বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন-কে আরও ত্বরান্বিত করছে। আমরা যখন একদিকে গাছ লাগিয়ে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলে পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা করছি, তখন অন্যদিকে আমাদের পায়ের নিচ দিয়েই হাজার হাজার কোটি টাকার মিথেন বাতাসে মিশে সেই চেষ্টাকে বিফল করে দিচ্ছে। এটি একটি আত্মঘাতী পরিস্থিতি। গ্যাসলাইনগুলো কি টাইম বোমা

অব্যবস্থাপনার দুষ্টচক্র: ভর্তুকি, বকেয়া এবং লোকসান

পেট্রোবাংলার আর্থিক চিত্রটি দেখলে সমস্যাটি আরও পরিষ্কার হয়। সংস্থাটি প্রতি ইউনিট গ্যাস প্রায় সাড়ে চার টাকা লোকসানে বিক্রি করছে। গত অর্থবছরে ভর্তুকি লেগেছে ৮,৯০০ কোটি টাকা। আর এখন পর্যন্ত মোট ভর্তুকির পরিমাণ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি! এর উপর রয়েছে বিদ্যুৎ খাতের কাছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বিল বকেয়া।

এই দুষ্টচক্রটি ভাবুন:

১. পুরোনো লাইনের কারণে গ্যাস অপচয় হচ্ছে।

২. অপচয়ের কারণে মোট সরবরাহ কমছে, কিন্তু খরচ কমছে না।

৩. ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।

৪. উচ্চ আমদানি খরচ এবং দেশীয় গ্যাসের কম দামের কারণে পেট্রোবাংলা লোকসান করছে।

৫. এই লোকসান মেটাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।

৬. যে টাকা দিয়ে পাইপলাইন মেরামত বা আধুনিকায়ন করা যেত, সেই টাকা ভর্তুকি আর বকেয়া বিলের ফাঁদে আটকে আছে।

অর্থাৎ, আমরা এমন একটি গর্তে পড়েছি, যেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা না করে আমরা গর্তটিকেই আরও বড় করছি।

সমাধানের পথে হাঁটা: আশা এবং করণীয়

অবশ্যই পেট্রোবাংলা কিছু ভালো উদ্যোগের কথা জানিয়েছে। প্রিপেইড মিটার স্থাপন, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ এবং নতুন কূপ খননের মাধ্যমে দৈনিক ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। স্থলভাগে নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনাও একটি দূরদর্শী পদক্ষেপ।

কিন্তু এই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার পাশাপাশি আশু করণীয় হলো এই সিস্টেম লসকে জরুরি ভিত্তিতে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু করা।

শেষ কথা: অপচয় রোধই নতুন গ্যাসক্ষেত্র

আমাদের মনে রাখতে হবে, সাশ্রয় করা এক ইউনিট গ্যাস মানে নতুন করে উৎপাদন করা এক ইউনিট গ্যাস। এই বিপুল অপচয় রোধ করতে পারলে আমাদের হয়তো নতুন এলএনজি টার্মিনালের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। যে হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বা ক্ষতির খাতায় লেখা হচ্ছে, সেই টাকা দিয়েই পুরো গ্যাস নেটওয়ার্ককে আধুনিক ও নিরাপদ করা সম্ভব।

গ্যাসের অপচয় রোধ করা কেবল একটি আর্থিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি একটি নৈতিক এবং পরিবেশগত দায়িত্ব। প্রতিটি গ্যাস কণার অপচয় মানে আমাদের পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর একটি আঘাত। তাই ফুটো পাইপলাইন মেরামত করা মানে শুধু টাকা বাঁচানো নয়, এটি আমাদের গ্রহকে বাঁচানোর লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

আপনার ভাবনা কী?

এই জাতীয় অপচয় এবং পরিবেশগত ক্ষতি রোধে নাগরিক হিসেবে আমাদের করণীয় কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টে জানান।

টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাস এবং পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আমরা একসাথে একটি সবুজতর ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ