শেষ শরতের দুপুর: বুড়ির বাঁধের জলকপাট এবং মাছ ধরার উৎসব
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সুক নদের বুড়ির বাঁধে প্রতিবছর জলকপাট খোলা হয় আশ্বিন মাসের শেষে। শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য তৈরি এই জলকপাট খোলার পর নদীতে পানি কমে আসে, তখন স্থানীয় মানুষ মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠেন। এ বছরও সেই রীতি অব্যাহত থাকলেও, অনেকেই মাছ কম পাওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরছেন।
জলকপাট খোলার ঐতিহ্য এবং স্থানীয় মানুষের উৎসব
বুড়ির বাঁধ এলাকায় জলকপাট খোলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় একটি ঐতিহ্য। প্রতিবছর জলকপাট খোলার পর দুই থেকে তিন দিন ধরে মাছ ধরার উৎসব চলে। এলাকার মানুষ ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে এ উৎসবে অংশ নেয়। অনেকেই বন্ধু-বান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে এখানে আসেন। তবে এবার মাছ কম পাওয়ায় অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন খালি হাতে।
কেন মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে?
- অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং অবৈধ জাল:
অনেকেই অভিযোগ করছেন, নদের পানিতে রিং জাল বসিয়ে মাছ ঘিরে রাখা হয়। এতে মাছ অন্যদের জালে উঠতে পারে না। স্থানীয় প্রশাসন এই বিষয়টির দিকে নজর রাখছে এবং ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
- পোনা মাছের উৎপাদন কম:
পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং মৎস্য বিভাগ প্রতিবছর বাঁধের পানিতে পোনা ছাড়লেও, মাছের উৎপাদন আগের মতো হচ্ছে না। পরিবেশ সংরক্ষণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন বজায় রাখতে আরও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা
পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার ছয়জন শিক্ষার্থী বুড়ির বাঁধে মাছ ধরতে এসে জানান, তারা প্রতি বছরই এই উৎসবে অংশ নেন। জয়ন্ত রায় বলেন, “মাছ পাওয়া না পাওয়া বড় কথা নয়, আমরা এখানে এসে দিনটি আনন্দে কাটাই। তবে আগে অনেক মাছ পাওয়া যেত, এখন তা অনেক কমে গেছে।”
সদর উপজেলার রশিদুল ইসলাম জানান, “আমরা আগে রুই, কাতলা, শোল, বোয়ালসহ অনেক রকম মাছ পেতাম। এখন ছোট মাছই খুব কম পাওয়া যায়। সাত ঘণ্টা ধরে জাল ফেলেছি, পেয়েছি মাত্র আধা কেজি মাছ।”
মাছ ধরার জন্য মানুষজনের কোলাহল, তবুও আশার আলো ক্ষীণ
এলাকাজুড়ে মানুষের কোলাহল এবং আনন্দের কমতি নেই, কিন্তু জালে মাছ না উঠলে হতাশা দেখা দেয়। অনেকে রসিকতা করেও বলেন, “একটা পুঁটি পেলেই বাড়ি চলে যাব।” মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে রিং জালের মতো বিষয়গুলোও ভূমিকা রাখছে বলে অনেকে মনে করেন।
পরিবেশ ও সেচের জন্য জলকপাটের গুরুত্ব
বুড়ির বাঁধ প্রকল্পটি ১৯৫০-এর দশক থেকে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৭০-এর দশকে নির্মিত সেচ খালের মাধ্যমে পানি কৃষিজমিতে পৌঁছানো হয়। তবে সঠিকভাবে সেচ ও মাছের উৎপাদন বজায় রাখতে হলে এই জলকপাট ও বাঁধের যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
পরবর্তী পদক্ষেপ: মাছের উৎপাদন বাড়াতে কী করা উচিত?
- অবৈধ জাল অপসারণ:
নদীতে মাছের প্রজনন ও প্রাপ্তি বজায় রাখতে হলে অবৈধ রিং জাল বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনকে নিয়মিত নজরদারি ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
- পোনা উৎপাদন ও পরিবেশ সংরক্ষণ:
মৎস্য বিভাগ প্রতি বছর বাঁধের পানিতে মাছের পোনা ছাড়ে। তবে আরও পোনা উৎপাদন ও পরিবেশ বান্ধব মাছ প্রজননের উদ্যোগ নিতে হবে। এতে স্থানীয় লোকজন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে এবং একইসঙ্গে পরিবেশও রক্ষা পাবে।
- জনসচেতনতা ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ:
পরিবেশ ও মাছ সংরক্ষণে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, যাতে জলকপাট খোলা থেকে শুরু করে মাছ ধরা পর্যন্ত সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।
শেষ কথা
বুড়ির বাঁধের জলকপাট খোলা নিয়ে উৎসব একটি স্থানীয় ঐতিহ্য। কিন্তু মাছের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় অনেকের আনন্দ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বাড়ানো এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব। তাই আসুন, সবাই মিলে সচেতন হই এবং মাছের প্রজনন ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিই।
আপনার এলাকায়ও কি এমন কোনো জলকপাট উৎসব হয়? কমেন্টে জানান এবং মাছ সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পোস্টটি শেয়ার করুন!