সিন্ধু পানিচুক্তি ১৯৬০ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তি ছিল, যা ওই অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা ও ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ন্ত্রণে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। চুক্তির অধীনে, ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় কিছু নদী ব্যবহার করতে দেওয়া হলেও, পাকিস্তান সিন্ধু নদী এবং তার প্রধান শাখা নদী ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু গত কিছু বছরে এই চুক্তির স্থগিতকরণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আলোচনায় আসে এবং এর পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে একটি নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে, পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে চুক্তির স্থগিতকরণের পরিণামগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত
সিন্ধু চুক্তি: ভারতের পদক্ষেপ ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ২৩ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেন, যা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। ভারতের দাবি, কাশ্মীরে ২০ এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তান-সমর্থিত গোষ্ঠী জড়িত, যার প্রতিক্রিয়ায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অপরদিকে, পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য’ বলে অভিহিত করেছে। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “পানি প্রবাহিত হবে, নতুবা রক্ত প্রবাহিত হবে” ।
নদী ও জলাশয়ের ইকোসিস্টেমে নেতিবাচক প্রভাব
সিন্ধু নদী অঞ্চলের পরিবেশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ, তবে সেখানকার পানি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল এবং বৈচিত্র্যময়। সিন্ধু নদী এবং তার শাখাগুলির পানি বণ্টন সঠিকভাবে না হলে ইকোসিস্টেমে বিশাল পরিবর্তন ঘটতে পারে। নদী এবং জলাশয়গুলোর প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পানি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। পানি সঠিকভাবে বিতরণ না হলে, প্রথমত নদীটির প্রবাহে অস্থিতিশীলতা আসবে। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে পানি বিতরণের বৈষম্য, বিশেষ করে যখন পানি প্রবাহ কমে যাবে, তখন তীরবর্তী অঞ্চলে কৃষি, পশুপালন এবং জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব
কৃষির জন্য সেচ ব্যবস্থার উপর নদীর পানি নির্ভরশীল। সিন্ধু নদী অঞ্চলে প্রধানত কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে গম, চাউল, পাট ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন হয়। পানি সরবরাহে কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ধরনের ক্ষতি শুধু কৃষক সমাজকেই নয়, বরং দেশটির খাদ্য নিরাপত্তাকেও বিপদের মধ্যে ফেলে দেবে। বিশেষ করে সিন্ধু নদী এবং তার শাখাগুলির পানি নির্ভরশীল অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা বা খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যা কৃষির উপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। এর ফলে, খাদ্য সংকট এবং জনসংখ্যার জীবিকা নির্বাহের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করবে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত পানি সংকট
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পূর্বের তুলনায় পৃথিবীর জলবায়ু আরও অস্থির হয়ে উঠছে। এর ফলে, পাহাড়ি অঞ্চলগুলির হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে, যার ফলে নদীগুলোর পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একদিকে বন্যা, অন্যদিকে দীর্ঘসময় জলাভাব সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে সিন্ধু নদী অঞ্চলে পানি সংকট মোকাবিলায় কূটনৈতিক ও পরিবেশগত পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত হয় বা ভুলভাবে পানি বণ্টন হয়, তাহলে এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের আরো তীব্র প্রভাব পড়বে।
জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রভাব
এছাড়া, সিন্ধু নদী এবং তার শাখাগুলিতে বহু প্রজাতির মাছ, জলজ উদ্ভিদ এবং জীবজন্তু বাস করে। যখন নদীর পানি সঠিকভাবে বণ্টিত না হবে, তখন তার উপর সজীব বস্তুগুলোতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে মাছের প্রজাতি, যেগুলি এই নদী অঞ্চলের আঞ্চলিক জীবনযাত্রার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তারা খাদ্য শৃঙ্খল এবং মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য। পানি সংকটের কারণে মাছের অভাব, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। এর পাশাপাশি, ওই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
পরিবেশগত সংকট ও মানবিক প্রভাব
অবশেষে, এই পরিবেশগত সমস্যা শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে না, এটি মানবিক সমস্যা হিসেবেও গড়ে উঠবে। পানি সংকটের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবিকা হারাবে, যা সামাজিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ অভিবাসন, এবং পরিবেশগত শরণার্থী সৃষ্টির কারণ হতে পারে। সিন্ধু নদী অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়া বা সীমান্তের কারণে পানি সংকট সৃষ্টি হলে, স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা এবং সমাজিক কাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সুপারিশ
এই পরিপ্রেক্ষিতে, দুই দেশের মধ্যে পরিবেশগত স্বার্থের প্রতি মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে, দু’দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি, সিন্ধু পানিচুক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে, বিজ্ঞানসম্মত পানিবণ্টন পদ্ধতির মাধ্যমে নদীর পানি ব্যবস্থাপনা করা উচিত। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নতুন করে স্থাপন করে দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত হলে পরিবেশ, সমাজ এবং জীববৈচিত্র্য বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। এই সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক ও পরিবেশগত সমাধান প্রয়োজন, যা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।