বজ্রপাতের ভয়াল ছোবল: প্রকৃতি কি শুধু কাঁদায়?
এই লেখার শুরুতেই একটি সত্যিকারের গল্প শোনাই। রাজবাড়ীর একটি গ্রামে রফিকুল নামে ১৭ বছরের এক কিশোর ধান কেটে বাড়ি ফিরছিল। আকাশে তখন হঠাৎ কালো মেঘ জমে উঠেছিল। গা ছমছম করা এক বিকেল। কিছুক্ষণ পরেই প্রচণ্ড শব্দে এক বজ্রপাত ঘটে, আর রফিকুল আর কখনো বাড়ি ফিরে আসেনি। তার মা রোকেয়া বেগম এখনও প্রতিদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন, এই আশায় হয়তো একদিন তার ছেলে ফিরে আসবে। বাংলাদেশে বজ্রপাত বিপর্যয় বিশ্লেষণ
এই গল্পটি কোনো ব্যতিক্রম নয়। বর্ষাকাল এলেই এমন অসংখ্য মৃত্যু আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই মর্মান্তিক মৃত্যুগুলোর পেছনে কি আমাদের কোনো দায় নেই?
বজ্রপাত এখন আর সাধারণ ঘটনা নয়
বাংলাদেশে বজ্রপাত এখন শুধু বর্ষার প্রাকৃতিক আচরণ নয়, এটি একটি বৈধ জাতীয় দুর্যোগ। ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করে, কারণ সে বছর বজ্রপাতে প্রাণ হারায় প্রায় ৩০০ জন মানুষ। এরপর প্রতি বছরই একই ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। বর্ষা শুরু হলেই বিভিন্ন এলাকায় বজ্রপাতে একসঙ্গে ১০-২০ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায়, অথচ আমরা এখনও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি।
কেন এত বেশি বজ্রপাত হচ্ছে?
বজ্রপাত বাড়ার একটি প্রধান কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ও জলীয় বাষ্প তৈরি হচ্ছে। এই তাপ ও বাষ্পের মিথস্ক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় বিদ্যুৎচমক ও বজ্রপাত। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বজ্রপাতের হার দক্ষিণ এশিয়ায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে বজ্রপাত বিপর্যয় বিশ্লেষণ
একই সঙ্গে একটি বড় কারণ হলো আমাদের পরিবেশ ধ্বংস। আগে গ্রামে বড় বড় গাছপালা ছিল, যেগুলো বজ্রপাত শোষণ করতে পারত। এখন চারপাশের মাঠগুলো খালি, গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, ফলে মানুষ নিজের অজান্তেই বজ্রপাতের সরাসরি লক্ষ্যবস্তু হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী কৃষি ও খোলা জায়গায় কাজের সঙ্গে যুক্ত। যারা বর্ষাকালেও মাঠে থাকে, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বৃষ্টি শুরু হলেও অনেকেই ফসল তোলার জন্য মাঠে থাকে, কিংবা গরু নিয়ে বের হয়। বজ্রপাত নামার সময় তারা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগও পায় না।
প্রাণহানি কি রোধ করা সম্ভব?
যদি বলা হয় বজ্রপাত সম্পূর্ণ রোধ করা সম্ভব নয়, তাহলে তা ঠিক। কিন্তু এই প্রাণহানির হার অনেক কমানো সম্ভব। আর এর জন্য প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হলো সচেতনতা।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বজ্রপাতের সময় কী করা উচিত, সেটাই জানে না। অনেকেই জানে না যে গাছের নিচে দাঁড়ানো বিপজ্জনক, মোবাইল ফোন ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ, কিংবা খোলা জায়গায় অবস্থান করা বিপদের। গ্রামাঞ্চলে এইসব তথ্য প্রচারের জন্য প্রয়োজন স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ, যেমন স্কুল, মসজিদ বা বাজারে মাইকিং, পোস্টার এবং সরাসরি আলোচনা। শিশুদের স্কুল পর্যায় থেকেই এ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া জরুরি।
এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়াতে হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাতের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম, এমনকি ‘বজ্রপাত সতর্কতা অ্যাপ’ তৈরি করেছে। কিন্তু এই অ্যাপ ব্যবহার বা তথ্য জানার সুযোগ খুব কম মানুষ পায়। বিশেষ করে গ্রামে মোবাইল ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা, ইন্টারনেটের অভাব এসব তথ্যকে কার্যকর হতে বাধা দেয়।
সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজন বজ্রপাতের সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য নিরাপদ কেন্দ্র তৈরি। যেমন ঘূর্ণিঝড়ের সময় মানুষ শেল্টারে আশ্রয় নেয়, বজ্রপাতের সময়েও ছোট ছোট দালান বা ছাউনিযুক্ত জায়গা তৈরি করা উচিত যেখানে কৃষক বা পথচারীরা দ্রুত আশ্রয় নিতে পারবেন। স্কুল-মাদ্রাসা, ইউনিয়ন ভবন, বাজারের পাশে এমন আশ্রয়স্থল থাকলে অনেক মৃত্যু এড়ানো যাবে।
আমাদের ভবনগুলোতেও বজ্রনিরোধক যন্ত্র লাগানো দরকার, বিশেষ করে স্কুল, হাসপাতাল বা ধর্মীয় স্থাপনায়। ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার’ নামের এই প্রযুক্তি বজ্রের আঘাতকে মাটির গভীরে নামিয়ে দিতে সাহায্য করে। শহরে বড় বড় বিল্ডিংগুলোতে এটি আছে, কিন্তু গ্রামে এর অস্তিত্ব প্রায় নেই।
পরিবেশ রক্ষায় আমাদের গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বজ্রপাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে গাছপালা প্রকৃতির সবচেয়ে বড় ঢাল হিসেবে কাজ করে। খোলা মাঠে বড় গাছ থাকলে বজ্রপাত সেগুলোর ওপর পড়ে, মানুষ রক্ষা পায়। এই বাস্তবতা বিবেচনা করে গাছ লাগানোর উদ্যোগকে আর বিলম্ব করা যাবে না।
আমরা কী করতে পারি?
ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেক কিছু করার আছে। বজ্রপাত শুরু হলে আমাদের উচিত খোলা জায়গা থেকে দ্রুত ঘরে ফেরা। যদি সম্ভব না হয়, কোনো ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া। মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এড়িয়ে চলা। আমাদের পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততিদের এগুলো শেখানো জরুরি। যখনই এমন ঘটনা ঘটে, তখন শুধু মৃত্যুর সংবাদ নয়, সেই সঙ্গে সতর্কতার বার্তাও ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—মানুষকে বোঝাতে হবে যে বজ্রপাত নিয়ে অবহেলা নয়, সচেতনতা প্রয়োজন।
বজ্রপাত কি শুধু গরিবদের মারে?
একবার একটি ছোট্ট শিশু সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছিল, “বজ্রপাত কি শুধু গরিবদের মারে?” প্রশ্নটা নিষ্পাপ, কিন্তু বেদনায় মোড়া। শহরে মানুষ ঘরে থাকে, গাছের নিচে দাঁড়ায় না, প্রযুক্তি আছে, আশ্রয় আছে। কিন্তু গ্রামে? খোলা মাঠ, খড়ের ঘর, আশ্রয়ের জায়গা নেই। তাই কি মৃত্যু শুধু তাদের জন্য?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতে হবে—নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে আমরা সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত। বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিন্তু সেই দুর্যোগে জীবন হারানো একেকটি পরিবারে সৃষ্টি করে চিরস্থায়ী শোক। সেই শোক থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হলো সতর্কতা, সচেতনতা ও সমষ্টিগত উদ্যোগ।
শেষ কথা
বর্ষাকাল আসে, আমাদের প্রাণ জুড়ায়। কিন্তু সেই বর্ষা যদি মৃত্যুর বার্তা নিয়ে আসে, তবে তা মেনে নেওয়া যায় না। বজ্রপাত ঠেকানো না গেলেও প্রতিটি জীবন রক্ষা করা সম্ভব। আমাদের দায়িত্ব শুধু নিজেদের নয়, আশেপাশের মানুষকেও সচেতন করা।
আজ রফিকুল, কাল হয়তো আমাদের কাউকে হারাতে হতে পারে। জীবন অমূল্য, আর জীবন বাঁচানো সম্ভব—শুধু একটু সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে।