যানজট, ধোঁয়া আর হর্ন – ঢাকার রাস্তা মানেই এক যুদ্ধক্ষেত্র। দূষিত বাতাস আমাদের শ্বাস আটকে দেয়, আর কার্বন নিঃসরণ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে আরও বাড়ায়। এই পরিচিত দৃশ্য থেকে মুক্তি দিতে এবার বিশাল এক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে: রাজধানী ঢাকায় নামানো হবে অত্যাধুনিক বিদ্যুৎ-চালিত বা ইলেকট্রিক বাস! আর এজন্য প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বিশাল এক প্রকল্প। ২৫০০ কোটি টাকার ইলেকট্রিক বাস
ভাবুন তো একবার, ধোঁয়া আর শব্দবিহীন বাস শহরের রাস্তায় চলছে – কী দারুণ দৃশ্য! পরিবেশের জন্য ভালো, স্বাস্থ্যের জন্য স্বস্তি। এই প্রকল্পের লক্ষ্যও মহৎ – ঢাকার বায়ুদূষণ কমানো, কার্বন নিঃসরণ রোধ করা, গণপরিবহনের মান উন্নয়ন করা এবং যানজট কমাতে সাহায্য করা। ৪০০টি নতুন বাস কেনা হবে, তৈরি হবে চার্জিং স্টেশন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে চলবে এই পরিবেশবান্ধব যান। সব মিলিয়ে এক আশার আলো।
কিন্তু এখানেই আসছে সেই গুরুতর প্রশ্নটা, যা প্রকল্পের গভীরে তাকালে দেখা যায় এবং কিছু বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ থেকে উঠে এসেছে। ২৫০০ কোটি টাকার বিশাল বিনিয়োগের এই চমকের আড়ালে কি লুকিয়ে আছে কোনো উদ্বেগজনক বাস্তবতা? ২৫০০ কোটি টাকার ইলেকট্রিক বাস
২৫০০ কোটির রহস্য: অপারেশন খরচ কে দেবে?
প্রকল্পের প্রস্তাবনা বিশ্লেষণ করে একটি বড়সড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে: এই বিশাল বিনিয়োগে বাস কেনা এবং প্রাথমিক অবকাঠামো তৈরি হওয়ার পর, অর্থাৎ প্রকল্প শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পর, এই বাসগুলো চালানোর বা অপারেশনের খরচ কে বহন করবে? সরকার কি তখন এগুলো চালাতে ভর্তুকি দেবে? এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
ভাবুন তো, ২৫০০ কোটি টাকা খরচ করে বাস কিনলাম, ডিপো বানালাম, কিন্তু পাঁচ বছর পর যদি এগুলো চালানো কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ অপারেশন খরচ কে দেবে তা ঠিক নেই, তাহলে কী হবে? বাসগুলো কি ফেলে রাখতে হবে? জনগণের করের টাকা এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ – এই বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ কি তাহলে অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে?
পুরনো ভুলের পুনরাবৃত্তি?
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করিয়ে দিচ্ছেন। অতীতেও ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে বা উন্নয়নের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু সেগুলো আশানুরূপ সফল হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, কোম্পানিভিত্তিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলে চালু হওয়া একটি নগর পরিবহন ব্যবস্থা প্রত্যাশা অনুযায়ী গতি পায়নি। ২৫০০ কোটি টাকার ইলেকট্রিক বাস
প্রশ্ন হলো, কেন আগের প্রকল্পগুলো পুরোপুরি সফল হয়নি? এর পেছনের কারণগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এই নতুন প্রকল্পে সেই ভুলগুলো শুধরানোর কোনো পরিকল্পনা আছে? নাকি আমরা কারণগুলো না জেনেই আবার একই পথে হাঁটছি – শুধু বিনিয়োগ বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কী কারণে নগর পরিবহন ব্যবস্থা কাজ করছে না, সেই মূল সমস্যাগুলো যদি সমাধান না করা হয়, তাহলে নতুন করে বিপুল বিনিয়োগ করাটা জনগণের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সফলতার অনিশ্চয়তা
এই ধরনের বড় প্রকল্পগুলোর সফলতা কেবল কারিগরি পরিকল্পনা বা আর্থিক বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে না। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। প্রভাবশালী মহল বা বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থের সংঘাত প্রকল্পের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা এবং দৃঢ় পদক্ষেপের অভাব অনেক ভালো উদ্যোগকেও ব্যর্থ করে দিয়েছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ২৫০০ কোটি টাকার ইলেকট্রিক বাস প্রকল্প কতটা সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে, তার পেছনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা, দুর্নীতির আশঙ্কা অথবা প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ – এই বিষয়গুলো যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়তো ঢাকার রাস্তার যানজট বা পরিবেশ দূষণ কমাতে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না।
পরিবেশের স্বপ্ন কি অধরাই থাকবে?
ইলেকট্রিক বাস নিঃসন্দেহে পরিবেশের জন্য খুব ভালো। বায়ুদূষণ ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে এর বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে পরিবেশবান্ধব পরিবহন সময়ের দাবি। কিন্তু যদি প্রকল্পটি টেকসই না হয়, যদি বাসগুলো নিয়মিত না চলে, যদি চার্জিং বা রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা হয় – তাহলে পরিবেশগত সুবিধাগুলোও পুরোপুরি পাওয়া যাবে না। একটি অচল বা নামমাত্র সচল ইলেকট্রিক বাস ব্যবস্থা পরিবেশের কোনো কাজে আসবে না।
সুতরাং, ২৫০০ কোটি টাকা খরচ করে ইলেকট্রিক বাস কেনার পরিকল্পনা যতটা চমকপ্রদ, এর দীর্ঘমেয়াদী পরিচালনা এবং টেকসই হওয়া নিয়ে প্রশ্নগুলো ততটাই উদ্বেগের। জনগণের অর্থ বা ঋণের টাকা যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় এবং এর ফল যেন পরিবেশ ও মানুষের জীবনে সত্যিই ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
শেষ কথা
ঢাকায় ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইলেকট্রিক বাস চালুর পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে একটি বড় স্বপ্ন। এটি ঢাকার পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন করার এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। তবে প্রকল্পের প্রস্তাবনায় অপারেশন খরচ নিয়ে অনিশ্চয়তা, অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নেওয়া এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মতো বিষয়গুলো গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়।
আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই উদ্বেগগুলো আমলে নেবেন এবং প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের জন্য একটি পরিষ্কার ও টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাবেন। জনগণের অর্থ এবং পরিবেশের ভবিষ্যৎ – দুটিই যেন সুরক্ষিত থাকে, সেটাই এখন আমাদের সবার প্রত্যাশা।
ঢাকায় ইলেকট্রিক বাস প্রকল্প নিয়ে আপনার কী ভাবনা? ২৫০০ কোটি টাকা খরচের এই পরিকল্পনা কি সফল হবে বলে আপনি মনে করেন? কমেন্ট করে জানান আপনার মূল্যবান মতামত।