25.8 C
Bangladesh
শুক্রবার, মে ৩০, ২০২৫
spot_img

বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে: বাংলাদেশ কি আসন্ন বিপদের জন্য প্রস্তুত?

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) সম্প্রতি এক আশঙ্কাজনক পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের মতো দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে। ডব্লিউএমও’র এই প্রতিবেদন শুধু একটি সংখ্যাতত্ত্ব নয়, বরং জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা এবং এর মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে

২৮শে মে প্রকাশিত ডব্লিউএমও-এর নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে অন্তত একটি বছর ২০২৪ সালের চেয়েও উষ্ণ হতে পারে। উল্লেখ্য, ২০২৪ সাল ইতোমধ্যেই উষ্ণতম বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই পূর্বাভাস শুধু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই উদ্বেগের কারণ নয়, বরং জলবায়ু-সংবেদনশীল বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। কারণ, এর প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘমেয়াদি খরা এবং চরম আবহাওয়ার ঝুঁকি আরও তীব্র হতে পারে।

ডব্লিউএমও আরও জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ। এছাড়া, ২০২৫-২০২৯ সালের মধ্যে অন্তত একটি বছর উষ্ণতম বছর হওয়ার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে উষ্ণতা বাড়ার ফলে সাগরের পানি গরম হচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং অতিবৃষ্টি, খরা ও দাবদাহের মতো চরম আবহাওয়ার নিয়মিত বৃদ্ধি ঘটছে। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে

বাংলাদেশের উপর সম্ভাব্য প্রভাব

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচু দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও গুরুতর প্রভাবের সম্মুখীন। আগামী পাঁচ বছরের গড় তাপমাত্রা যদি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, তবে দেশের নিম্নাঞ্চলে বন্যা ও লবণাক্ততার প্রকোপ বাড়বে, কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়বে।

  1. বন্যা ও জলাবদ্ধতা: তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ের বরফ দ্রুত গলতে শুরু করবে, যা বাংলাদেশের নদীগুলোতে বন্যার ঝুঁকি বাড়াবে। এছাড়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলো স্থায়ীভাবে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
  2. লবণাক্ততা: উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মিঠা পানির সংকট দেখা দেবে, যা কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
  3. কৃষি উৎপাদন হ্রাস: তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা এবং লবণাক্ততার কারণে ধান, পাটসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন কমতে শুরু করবে, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
  4. বাস্তুচ্যুতি: প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকার মানুষজন তাদের ঘরবাড়ি হারাতে বাধ্য হবে, যা অভ্যন্তরীণ অভিবাসন এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।

ডব্লিউএমও-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় গড় বৃষ্টিপাত বেড়েছে এবং এই ধারা ২০২৫-২০২৯ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে, এটি সকল মৌসুমের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। এর অর্থ হলো, কিছু সময়ে অতিবৃষ্টি এবং কিছু সময়ে তীব্র খরা দেখা যেতে পারে, যা কৃষি এবং পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে

ডব্লিউএমও আরও জানায়, আর্কটিক অঞ্চলে শীতকালে (নভেম্বর থেকে মার্চ) তাপমাত্রা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় ৩.৫ গুণ বেশি, অর্থাৎ প্রায় ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে ব্যারেন্ট সাগর, বেরিং সাগর এবং ওখোতস্ক সাগরে বরফের পরিমাণও হ্রাস পাবে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে আরও অবদান রাখবে।

ডব্লিউএমও-এর উপ-মহাসচিব কো ব্যারেট বলেন, ‘গত দশটি বছর ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম বছর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রতিবেদন আগামীতে কোনো স্বস্তির ইঙ্গিত দেয় না। এর অর্থ হলো, আমাদের অর্থনীতি, জীবনযাত্রা, বাস্তুসংস্থান ও পৃথিবী আরও চাপে পড়বে।’

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও প্যারিস চুক্তি

প্যারিস চুক্তির অধীনে, দেশগুলো বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়লে জলবায়ু পরিবর্তনের আরও মারাত্মক প্রভাব এবং চরম আবহাওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে।

ডব্লিউএমও-এর এই প্রতিবেদন প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জনের পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও করণীয়

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:

  1. অভিযোজন পরিকল্পনা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং কার্যকর অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ এবং প্রযুক্তির সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
  2. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস এবং মোকাবিলা করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং জরুরি ত্রাণ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
  3. কৃষি খাতে বিনিয়োগ: জলবায়ু সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ধরে রাখতে হবে। পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার এবং বিকল্প চাষাবাদের পদ্ধতি প্রচলন করতে হবে।
  4. নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা: নদী খনন এবং বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বন্যার ঝুঁকি কমাতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে পানির সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
  5. বনায়ন: উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি এবং সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে, যা কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
  6. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা আদায় করতে হবে। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে বাংলাদেশের দাবি তুলে ধরতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে হবে।

চলতি বছর কপ-৩০ সম্মেলনে জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা (এনডিসি) নিয়ে আলোচনা হবে, যা প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকেও এই সম্মেলনে একটি শক্তিশালী এবং বাস্তবসম্মত এনডিসি উপস্থাপন করতে হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় দেশের সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে।

ডব্লিউএমও-এর এই প্রতিবেদন আমাদের জন্য একটি কঠিন বার্তা বহন করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চরম ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তবে, সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা এই ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারি এবং একটি নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারি। এখন প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

আপনার মতামত জানান

ডব্লিউএমও-এর এই প্রতিবেদন নিয়ে আপনার চিন্তা কী? জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় আপনার কী পরামর্শ রয়েছে? নিচে মন্তব্য করে আমাদের জানান। আপনার প্রতিটি মতামত আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সাহায্য করবে। পরিবেশ সুরক্ষায় আপনার সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

আরও জানতে ভিজিট করুন

যদি আপনি জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে আরও জানতে চান, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন এবং নিউজলেটারে সাবস্ক্রাইব করুন। একসাথে কাজ করার মাধ্যমেই আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ