বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি আর বিধ্বংসী ঝড়-বন্যা—এই শব্দগুলো এখন আমাদের জীবনের تلخ বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকট আমাদের গ্রহকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর জন্য প্রধানত দায়ী মানুষের লাগামহীন কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশ দূষণ। এই সংকট মোকাবেলায় যখন আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর আন্তর্জাতিক চুক্তির দিকে তাকিয়ে আছি, তখন হয়তো সমাধানের অনেক সূত্র লুকিয়ে আছে আমাদের শেকড়ে, আমাদের ঐতিহ্যে এবং আমাদের ধর্মীয় নির্দেশনার গভীরে। জলবায়ু সংকট মোকাবেলা
আজ থেকে চৌদ্দশ বছরেরও বেশি সময় আগে ইসলাম পরিবেশ রক্ষার জন্য এমন এক átfogó নীতিমালা দিয়েছে, যা আজকের দিনেও অবিশ্বাস্যভাবে প্রাসঙ্গিক। এটি শুধু কিছু বিচ্ছিন্ন উপদেশ নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা মানুষকে পৃথিবীর তত্ত্বাবধায়ক বা খলিফা হিসেবে তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আসুন, বিশ্লেষণ করে দেখি, জলবায়ু পরিবর্তনের এই ভয়াবহ সংকট মোকাবেলায় ইসলামের কালজয়ী নির্দেশনাগুলো কীভাবে এক অনন্য পথ দেখাতে পারে। জলবায়ু সংকট মোকাবেলা
ভূমির প্রতি যত্ন: ইসলামের টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা
আধুনিক নগর পরিকল্পনার একটি বড় সংকট হলো ভূমির অপচয়। একদিকে উর্বর কৃষি জমি অকেজো পড়ে থাকছে, অন্যদিকে কংক্রিটের জঙ্গল গিলে খাচ্ছে সবুজ। ইসলাম ভূমির প্রতিটি কণার পরিকল্পিত ব্যবহারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। হাদিসে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যার জমি আছে সে যেন নিজে তা চাষ করে, আর নিজে না পারলে যেন অন্য ভাইকে চাষ করতে দেয়, তবু যেন এক টুকরো জমিও অনাবাদী না থাকে।
ভাবুন তো, যদি এই একটি নির্দেশনাও বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়ন করা যেত! প্রতিটি বাড়ির ছাদ, খালি পড়ে থাকা প্লট, রাস্তার পাশের অ ব্যবহৃত জায়গা যদি সবুজ হয়ে উঠত, তাহলে একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো, তেমনই বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমে এসে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরে আসত। এটি প্রকৃতির প্রতি ইসলামের গভীর দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জলবায়ু সংকট মোকাবেলা
বৃক্ষরোপণ: কিয়ামত পর্যন্ত একটি চলমান বিপ্লব
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রগুলোর একটি হলো বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন। ইসলাম বৃক্ষরোপণকে কেবল একটি ভালো কাজ হিসেবেই দেখেনি, বরং একে সর্বোচ্চ স্তরের ইবাদত এবং চলমান দান বা ‘সদকায়ে জারিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
নবী (সা.)-এর একটি হাদিস এই বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে তুলে ধরে। তিনি বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।’ (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ)। এই একটি বাক্যেই লুকিয়ে আছে পরিবেশের প্রতি ইসলামের সুগভীর দর্শন। এটি চরম হতাশার মাঝেও সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাজ করা এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের দায়িত্ব পালনের এক শক্তিশালী বার্তা। একইভাবে, বিনা প্রয়োজনে একটি উপকারী গাছ কাটাকে জাহান্নামের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার: অপচয়ের বিরুদ্ধে ইসলামের কঠোর অবস্থান
আমাদের বর্তমান ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ‘অপচয়’ এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদের 무분별 ব্যবহার পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। ইসলাম অপচয়কে সরাসরি শয়তানের কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
পানির অপচয় নিয়ে একটি ঘটনা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। একবার নবী (সা.) তাঁর এক সাহাবীকে অজুর সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতে দেখে বললেন, ‘কেন এই অপচয়?’ সাহাবী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অজুতেও কি অপচয় হয়?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এমনকি প্রবহমান নদীর তীরে বসেও (অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা) অপচয়।’ (ইবনু মাজাহ)। এই নির্দেশনা থেকে বোঝা যায়, সম্পদ কতটুকু আছে তা বিবেচ্য নয়, মূল বিষয় হলো সম্পদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামান্য ব্যবহারও যে অপচয় এবং গর্হিত কাজ—এই বোধ জাগ্রত হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
দূষণ প্রতিরোধ: পরিচ্ছন্নতার ইসলামী দর্শন
ইসলামে পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। এই পরিচ্ছন্নতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং পারিপার্শ্বিক এবং পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
- পানি ও বায়ু দূষণ রোধ: ইসলামে বদ্ধ পানিতে প্রস্রাব-পায়খানা করে তা দূষিত করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। একইভাবে, চলাচলের রাস্তায়, ছায়াদার স্থান বা পানির উৎসের কাছে মলমূত্র ত্যাগকে ‘অভিশাপযোগ্য’ কাজ বলা হয়েছে। এই নির্দেশনাগুলো আধুনিক জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ বিজ্ঞানের মূলনীতির সাথে হুবহু মিলে যায়।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: ময়লা-আবর্জনা ও মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলার যে রীতি ইসলামে রয়েছে, তা মূলত একটি আদি ও অত্যন্ত কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং রোগজীবাণু ছড়ানো বন্ধ হয়।
- বায়ু নির্মল রাখা: হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা, যাতে জীবাণু না ছড়ায়; দুর্গন্ধযুক্ত কিছু খেয়ে মসজিদে বা জনসমাবেশে যেতে বারণ করা; এবং সুগন্ধি ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান—এই সবগুলোই看似 ছোট ছোট নির্দেশনা, কিন্তু সম্মিলিতভাবে এগুলো একটি সুস্থ, পরিচ্ছন্ন এবং দূষণমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে, যা পরোক্ষভাবে পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
জীবজগতের প্রতি করুণা: জীববৈচিত্র্য রক্ষার ইসলামী অঙ্গীকার
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য জীববৈচিত্র্য বা বায়োডাইভারসিটি টিকিয়ে রাখা অপরিহার্য। বন ধ্বংস, শিকার এবং দূষণের কারণে আজ হাজারো প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ইসলাম মানুষসহ প্রতিটি প্রাণীর অধিকার নিশ্চিত করেছে। জীবজন্তুর প্রতি দয়া ও ভালোবাসা প্রদর্শনকে পুণ্যের কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। একটি হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক দয়ার্দ্র হৃদয়ের অধিকারীর জন্য পুরস্কার আছে।’ (বুখারি)। এমনকি সামান্য একটি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতাও যে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতার কারণ হতে পারে, এই বিশ্বাস জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এক শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে।
শেষ কথা: বিশ্বাস যখন কর্মে রূপান্তরিত হয়
উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ইসলাম পরিবেশ বিপর্যয়কে একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংকট হিসেবে দেখে। এটি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই পৃথিবী আমাদের কাছে একটি আমানত এবং এর প্রতিটি উপাদানের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। ভূমির যত্ন নেওয়া, একটি গাছ লাগানো, পানি অপচয় না করা বা কোনো প্রাণীর প্রতি দয়া দেখানো—এগুলো শুধু ব্যক্তিগত पुण्य অর্জনের উপায় নয়, বরং এই গ্রহের একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক বা ‘খলিফা’ হিসেবে আমাদের অবশ্য করণীয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই মহাদুর্যোগের দিনে, আন্তর্জাতিক নীতি বা প্রযুক্তির পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নৈতিক জাগরণ। আসুন, কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে নয়, বরং পৃথিবীর একজন সচেতন বাসিন্দা হিসেবে এই কালজয়ী নির্দেশনাগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করি। আপনার বাসার ছাদে বা বারান্দায় একটি গাছ লাগানোর মাধ্যমেও এই মহৎ যাত্রার অংশ হতে পারেন। পরিবেশ রক্ষায় আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগের কথা কমেন্টে আমাদের জানান।