বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্কট একটি বহুল আলোচিত সমস্যা, যা দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশের ক্ষতি করে আসছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি এক নাগরিক সংলাপে এই বিষয়টি তুলে ধরে বলেছেন, দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা ও সমাধান
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অস্থির অবস্থা: সংকট এবং সমাধান
বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২৫,০০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ৫৫% সঠিকভাবে নিষ্কাশিত হয় না। এই বর্জ্য থেকে উদ্ভূত ক্ষতিকর গ্যাসের ফলে বাতাস, পানি এবং মাটি দূষিত হয়, যা জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ঢাকার মতো বড় শহরে, যেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত, সেখানকার ল্যান্ডফিল্ডগুলো ৮০% পূর্ণ হয়ে গেছে এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলোতে আর জায়গা থাকবে না।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের আশাবাদ
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় খুব ভালো ও শক্তিশালী আইন তৈরি করা সম্ভব হলেও তার বাস্তবায়ন হবে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের অংশ হিসেবে। তিনি জানান, ঢাকা শহরে শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ এবং বালু নদীর দূষণ কমাতে সরকারের একটি পরিকল্পনা চলছে, তবে এর জন্য অনেক সময় এবং জনগণের সচেতনতা প্রয়োজন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা ও সমাধান
সচেতনতার অভাব: সমস্যা এবং সমাধান
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটি সমাজের প্রতিটি স্তরের জন্য গুরুতর এক সংকট। সচেতনতার অভাব বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন ২৫,০০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, কিন্তু এর ৫৫% সঠিকভাবে নিষ্কাশিত হয় না। দেশের প্রতিটি শহরেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থা নাজুক এবং এটি জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য বিপদজনক।
ঢাকা শহরের মতো বড় শহরে, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেশি, সেখানে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন। বিশেষ করে প্লাস্টিক বর্জ্য এবং ইলেকট্রনিক বর্জ্য, যা সাধারণত পুনঃব্যবহৃত হয় না এবং সেগুলো ল্যান্ডফিল্ডে জমা হয়ে পরিবেশের ক্ষতি করে। এই ধরনের বর্জ্যগুলো অত্যন্ত ধীর গতিতে পচে এবং তা মাটির গুণগত মান হ্রাস করে, নদী ও জলাশয়কে দূষিত করে এবং বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জনগণের সচেতনতার অভাব। অধিকাংশ মানুষ এখনও সঠিকভাবে বর্জ্য নিষ্কাশনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নয় এবং প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন উপকরণ সহজেই নিষ্কাশন করা হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির ময়লা একটি জায়গায় গচ্ছিত রাখা হয়, যা পরে অবৈধভাবে ভ্রাম্যমাণ ময়লা সন্নিবেশকারী স্থানে ফেলা হয়। এই অভ্যাসের কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সিস্টেম কার্যকর হতে পারে না এবং জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে থাকে।
সমাধান এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা
এই বিশাল সমস্যা সমাধানে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, সরকারের উচিত শক্তিশালী ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন তৈরি করা, যা শুধুমাত্র কাগজে নয়, বরং সমাজে বাস্তবায়ন হতে পারে। যেমন, “ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন” বা “পরিবেশ সংরক্ষণ আইন”-এর মতো কঠোর আইন প্রয়োগে সাহায্য করতে পারে। তবে, আইন সঠিকভাবে কার্যকর হতে হলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি, সরকারের পক্ষ থেকেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এছাড়াও, সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে—যেমন স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটিতে পরিবেশ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া এবং বিভিন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি চালানো। জনসাধারণের মধ্যে বর্জ্য আলাদা করার অভ্যাস গড়ে তোলা, যেমন পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করা, প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা, এবং বিদ্যুৎ খরচ কমাতে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।
পরিকল্পনার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বর্জ্য পুনঃব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা পণ্য তৈরি করতে সাহায্য করবে।
ঢাকার চারটি দূষিত নদী, যেমন বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং বালু নদী বাঁচানোর জন্য সরকার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে নদী পরিষ্কার করা, অবৈধ ডাম্পিং সাইটগুলি বন্ধ করা, এবং বর্জ্য পুনঃব্যবহার ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করা। তবে, এই ধরনের প্রকল্প সফল করার জন্য সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে, এবং জনগণকেও তাদের অবদান রাখতে হবে।
সবশেষে, দীর্ঘমেয়াদী সমাধান কেবল আইন ও সরকারী পদক্ষেপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি জনগণের মনোভাব এবং আচরণে পরিবর্তন আনার উপর নির্ভর করবে। পরিবর্তন আসতে হলে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে বদলাতে হবে, যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করবে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় তার ভূমিকা পালন করবে।
অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা শুধু একটি প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা, যার সমাধানে সরকার, নাগরিক এবং বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনকে একযোগে কাজ করতে হবে। সময়, শক্তিশালী আইন এবং জনসচেতনতা—এই তিনটি উপাদান মিলে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্ভব হবে।
শেষ কথা
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে, শুধু সরকারের ওপরই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে হবে না, আমাদের সবার সচেতন হতে হবে, নিজেদের অবহেলা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত না করার জন্য। পরিবেশ রক্ষা আমাদের একান্ত দায়িত্ব।
Call to Action: আপনি কী মনে করেন? বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংকট সমাধানে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? মন্তব্যে জানান এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে আমাদের সাথে থাকুন।